The Indian Universities Act 1904

  লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতি ও ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটঃ

ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় বহু সমস্যা দেখা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার মান ক্রমশ নিম্নগামী হচ্ছিল, পরীক্ষার মানদণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছিল, শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাকরিমুখী প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছিল, এবং প্রশাসনিক শৃঙ্খলার অভাব প্রকট হচ্ছিল।এই পরিস্থিতিতে লর্ড কার্জন (Lord Curzon) ১৮৯৯ সালে ভারতের ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ব্রিটিশ শাসনের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে "শৃঙ্খলা ও দক্ষতা" ফিরিয়ে আনার জন্য সচেষ্ট হন।কার্জনের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উদ্দেশ্য ছিল কেবলমাত্র ডিগ্রি প্রদান নয়, বরং উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন। তাঁর দৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠেছিল “Exam factories” বা কেবল পরীক্ষামুখী প্রতিষ্ঠান।

১৯০২ সালের “Indian Universities Commission” গঠন:

কার্জন ভারতের শিক্ষার দুরবস্থা যাচাই করতে ২৭ জানুয়ারি, ১৯০২ সালে Indian Universities Commission গঠন করেন।এই কমিশনের সভাপতি ছিলেন Sir Thomas Raleigh, এবং সদস্য সংখ্যা ছিল মোট ১৩ জন, যার মধ্যে মাত্র একজন ভারতীয় সদস্য ছিলেন — সৈয়দ হোসেন বিলগ্রামী (Syed Hussain Bilgrami)।

কমিশনের প্রধান উদ্দেশ্য: "To enquire into the condition and prospects of the Indian Universities, and to suggest measures for their improvement."

অর্থাৎ, ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব করা।

কমিশনের প্রধান সুপারিশসমূহ:

1. বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কার্যাবলী যেন শিক্ষা ও গবেষণার প্রসারে বেশি মনোযোগ দেয়, শুধুমাত্র পরীক্ষার ফলাফলে নয়।

2. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে সরকারের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করা উচিত।

3. কলেজ অনুমোদন (affiliation) ও পরীক্ষা ব্যবস্থার উপর আরও কড়া নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন।

4. সিনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য সংখ্যা সীমিত করে দক্ষ পরিচালনা নিশ্চিত করা দরকার।

5. অধ্যাপকদের বেতন, যোগ্যতা ও নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও নির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত।

এই সুপারিশগুলির ভিত্তিতেই কার্জন ১৯০৪ সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন (Indian Universities Act, 1904) প্রণয়ন করেন।


 ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন (Indian Universities Act, 1904)

প্রবর্তন: লর্ড কার্জন কর্তৃক প্রস্তাবিত এই বিলটি ২১ মার্চ, ১৯০৪ সালে ভারতের Imperial Legislative Council-এ উপস্থাপিত হয় এবং ১৯০৪ সালের জুলাই মাসে আইন হিসাবে গৃহীত হয়।

কার্জনের মূল উদ্দেশ্য ছিল —“To raise the standard of education all round and particularly of higher education.”

আইনের প্রধান ধারাসমূহ:

(১) বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যপরিধি সম্প্রসারণ:  এই আইনে বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু পরীক্ষা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে না রেখে,

শিক্ষাদান,গবেষণা পরিচালনা,লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনা,পাঠক্রম পরিকল্পনাইত্যাদির জন্য ক্ষমতা দেওয়া হয়।

(২) সিনেট (Senate)-এর পুনর্গঠন:  সিনেটের সদস্য সংখ্যা সীমিত করা হয় — কমপক্ষে ৫০ জন এবং সর্বাধিক ১০০ জন।সদস্যরা আজীবন নয়, বরং ৫ বছরের জন্য মনোনীত হবেন।এর মধ্যে ৪০% সদস্য সরাসরি সরকার কর্তৃক মনোনীত হতেন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করেছিল।বাকিরা নির্বাচিত হতেন প্রাক্তন ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্য থেকে।

(৩) সিন্ডিকেট (Syndicate) গঠন:  প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে Vice-Chancellor (উপাচার্য) এর নেতৃত্বে ৭ থেকে ১৫ জন সদস্য নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গঠন করা হয়।সিন্ডিকেটের কাজ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা।এতে অধ্যাপকদের প্রতিনিধিত্ব ছিল প্রায় ২০%।

(৪) কলেজ অনুমোদন (Affiliation):  কলেজ অনুমোদনের ক্ষেত্রে মানদণ্ড কঠোর করা হয়।সরকার চাইলে কোনো কলেজের অনুমোদন স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে।এর ফলে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।

(৫) বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ও গবেষণার উন্নতি:  বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও উচ্চতর শিক্ষা প্রসারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।অধ্যাপকদের যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ ও কাজের মান উন্নয়নের সুপারিশ করা হয়।

(৬) বিশ্ববিদ্যালয় আইনের নিয়ন্ত্রণ:  বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রণীত কোনো আইন বা নিয়ম কার্যকর করার পূর্বে সরকারের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়।এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন প্রায় বিলুপ্ত হয়।


আইনের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া:

ভারতীয় প্রতিক্রিয়া: ভারতীয় সমাজের শিক্ষিত মহল এই আইনকে “Anti-National” (জাতীয়তাবিরোধী) বলে অভিহিত করে। কারণ—

1. বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর সরকারের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছিল।

2. বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভারতীয় শিক্ষাবিদদের অংশগ্রহণ সীমিত ছিল।

3. শিক্ষা স্বাধীনতার পরিবর্তে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।

4. আইন প্রণয়নের সময় কোনো ভারতীয় শিক্ষাবিদকে পরামর্শের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।


বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ H.C.E. Zacharias এই আইন সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন— “The Universities Act of 1904 did not kindle a real love for education among Indians, rather it bound them more firmly to the bureaucratic machine.”

অর্থাৎ, এই আইন ভারতীয়দের শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা বাড়ায়নি, বরং তাদের আরও সরকারি চাকরিমুখী করে তুলেছিল।


 আইনটির ইতিবাচক দিকসমূহ:  যদিও আইনটি জাতীয়তাবাদীদের বিরোধিতা কুড়িয়েছিল, তবু এর কিছু ইতিবাচক প্রভাবও ছিল—

1. উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নতুন দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

2. শিক্ষকদের যোগ্যতা ও প্রশাসনিক দক্ষতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

3. বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী ছাত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

4. নিয়মিত সিনেট ও সিন্ডিকেট সভা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কিছুটা কার্যকর করে তোলে।


সমালোচনা ও মূল্যায়ন:

সমালোচনা:

আইনটি ছিল অতি আমলাতান্ত্রিক।

সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন চিন্তা ও গবেষণার স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ হয়েছিল।

ভারতীয় জাতীয় চেতনার উত্থানকে দমন করার এক প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছিল।


মূল্যায়ন:তবু বলা যায়, কার্জনের শিক্ষানীতি ভারতীয় উচ্চশিক্ষাকে একটি সংগঠিত রূপ দেওয়ার প্রথম প্রচেষ্টা ছিল।তিনি যে “মানোন্নয়ন”-এর কথা বলেছিলেন, সেটি যদিও বাস্তবে আমলাতান্ত্রিক রূপ নিয়েছিল, তবুও এর ফলে শিক্ষা-সংগঠন, পরিকাঠামো ও একাডেমিক কার্যক্রমের শৃঙ্খলা কিছুটা উন্নত হয়।


 উপসংহার:

লর্ড কার্জনের ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন একদিকে যেমন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত করেছিল, অন্যদিকে এটি ভারতীয় শিক্ষার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার ধারণাকে ক্ষুণ্ণ করেছিল।এই আইনের ফলেই পরবর্তীকালে শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের মানসিক ভিত্তি শক্তিশালী করে তোলে।

Comments

Popular posts from this blog

National Education Policy (2020)

Charter Act of 1813 and Its Educational Implication.

National Policy on Education (1968)