Charter Act of 1813 and Its Educational Implication.

 ১৮১৩ সালের সনদ আইন (Charter Act of 1813)


ঐতিহাসিক পটভূমি

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্য করতে এসে ভারতে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে কোম্পানি বিশেষ তৎপরতা দেখালেও শিক্ষা প্রসারের ব্যাপারে তারা ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। এদেশে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তাদের কোনো নির্দিষ্ট নীতি ছিল না এবং তারা শিক্ষা প্রসারের নৈতিক দায়িত্বকে তেমন গুরুত্ব দিত না।

এই অবস্থায় ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস তাঁর প্রতিবেদনে ভারতে শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন এবং পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে কোম্পানির কাছে আবেদন করেন।  ১৮১৩ সালে সনদ আইন (Charter Act) পাশ হয় এবং এই আইন বলে কোম্পানি আগামী ২০ বছরের জন্য ভারত শাসনের অধিকার পায়।


সনদ আইনের মূল বিধান

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যখন সনদ আইনটি উপস্থাপিত হয়, তখন জনমতের চাপে আইনের ৪৩ নং ধারায় ব্রিটিশ ভারতে শিক্ষা বিস্তারের জন্য একটি শর্ত যুক্ত করা হয়। এখানে বলা হয় যে:

"বার্ষিক কমপক্ষে এক লক্ষ টাকা ভারতীয় সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন, উন্নয়ন ও দেশীয় শিক্ষিতদের উৎসাহদান এবং ব্রিটিশ ভারতের অধিবাসীদের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রবর্তন ও প্রসারের জন্য কোম্পানি ব্যয় করবে।"

আইনের মূল ধারাসমূহ

আইনের ৪৩ বা ৭৪ নং ধারা অনুযায়ী বলা হয়—  “ভারতে সাহিত্য পুনরুজ্জীবন, দেশীয় পণ্ডিতদের উৎসাহ প্রদান এবং বিজ্ঞান শিক্ষার প্রবর্তন ও প্রসারের জন্য প্রতি বছর কোম্পানিকে ন্যূনতম এক লক্ষ টাকা ব্যয় করতে হবে।”

এই ধারাটিকে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিলঃ

১.সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন, উন্নয়ন ও ভারতীয় শিক্ষিতদের উৎসাহদান (Revival and improvement of Literature and encouragement of the Learned natives of India)

২. ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রবর্তন ও প্রসার (Introduction and development of Knowledge of science among the inhabitants of the British territories in India)


সনদ আইনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য

১. মিশনারীদের ধর্মপ্রচার ও শিক্ষা বিস্তার  ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনে গ্রান্টের প্রস্তাব আংশিকভাবে মেনে নেওয়ার ফলে মিশনারীদের ধর্মপ্রচার ও শিক্ষাবিস্তার ব্যাপারে অনেকটা স্বাধীনতা দেওয়া হয়। ফলে মিশনারীরা প্রথমে পুস্তক প্রকাশ, নারীশিক্ষার বিস্তার, অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কাজে ব্রতী হন। এই সময় থেকেই খ্রিস্টান মিশনারীরা অধিকতর উদ্যমে বিভিন্ন অঞ্চল অধিগ্রহণ করতে ও পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে অগ্রসর হয়েছিল।


২. শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে অর্পণ ১৮১৩ সালের সনদ আইন প্রবর্তিত হওয়ার মাধ্যমে তত্কালীন ভারত শাসক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপর শিক্ষার দায়িত্ব বর্তায়। এটি ছিল ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রথম পদক্ষেপ।


৩. শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দ শিক্ষার জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এই বরাদ্দকৃত অর্থ কীভাবে ব্যয় করা হবে, সে বিষয়ে সনদ আইনে অস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থক ভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল এবং প্রায় দুই দশক ধরে এই বিতর্ক চলেছিল।


৪. শিক্ষাবিস্তারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার সূচনা  এই আইনকে ভারতের শিক্ষাবিস্তারের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা যায়। অর্থাৎ, ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করে।


৫. এক যুগের সমাপ্তি ও নতুন যুগের প্রারম্ভ ১৮১৩ সালের সনদ আইন ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে এক যুগের সমাপ্তি ও নতুন যুগের প্রারম্ভ বলে ধরা হয়ে থাকে। কেননা এই সনদ আইনের ফলে গ্রান্ট ও উইলবারফোর্সের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অধিবাসীদের শিক্ষাদানের জন্য কোম্পানির উপর বাধ্যতামূলকভাবে অর্থ ব্যয়ের দায়িত্ব বর্তায়।


৬. পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের পথ সুগম করা এই সনদ আইন পাশ্চাত্য শিক্ষাবিস্তারের পথকে অনেকাংশে সুগম করে দিয়েছিল এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারকে একধাপ এগিয়ে দিয়েছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষার পথে একটি সন্ধিক্ষণ হিসেবে চার্টার অ্যাক্টের তাৎপর্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।


৭. আধুনিক ভারতীয় শিক্ষার ভিত্তি প্রস্তর ১৮১৩ সালের সনদ আইন ছিল আধুনিক ভারতীয় শিক্ষার ভিত্তি প্রস্তর। পাশ্চাত্য শিক্ষা, বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষাদানের বিষয়টি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অর্জন করে। বহু বিতর্ক-আলোচনার পর পরবর্তীকালে (১৮৩৫) পাশ্চাত্য শিক্ষানীতি সরকারিভাবে গৃহীত হয়।


৮. পরোক্ষভাবে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বীকৃতি দেওয়া ১৮১৩ সালের আইনে পরোক্ষভাবে বেসরকারি উদ্যোগকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। তেমনি ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ পাশাপাশি চলতে থাকে।


৯. ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার সূচনা এই আইনের মাধ্যমে ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার সূচনা হয়। এই ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ বপন করা হয়, যা স্বাধীন ভারতেও অব্যাহত রয়েছে।


পরিশেষই বলা যাই , ১৮১৩ সালের সনদ আইন ছিল একটি আপস-মীমাংসার ফল। ভবিষ্যৎ শিক্ষাবিতর্কের বীজ এর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। এই সনদ আইন থেকে উঠে এসেছিল আধুনিক শিক্ষার কাঠামো। এই আইন ইংরেজি শিক্ষার পথকে প্রশস্ত করেছিল। তাই বলা হয়, "The Charter Act of 1813 forms a milestone in the history of modern education in India" - অর্থাৎ, ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে ১৮১৩ সালের সনদ আইন একটি মাইলফলক স্বরূপ। এটি ছিল আধুনিক ভারতের ভবিষ্যৎ শিক্ষানীতির ভিত্তি।

Comments

Popular posts from this blog

National Education Policy (2020)

National Policy on Education (1968)