Shimla Conference 1901

 সিমলা সম্মেলন (Shimla Conference, 1901)

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটঃ

উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতের রাজনৈতিক আবহে জাতীয়তাবাদী চেতনা ক্রমশ উগ্র রূপ ধারণ করছিল।লর্ড কার্জন (Lord Curzon) ১৮৯৯ সালে ভারতের ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্ব নেন এমন এক সময়ে, যখন দেশজুড়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটছে, এবং রাজনৈতিক সংগঠন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।কার্জন বিশ্বাস করতেন, এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল উৎস ছিল শিক্ষিত তরুণ সমাজ এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়।তাই তিনি শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইলেন।

এই উদ্দেশ্যেই তিনি ১৯০১ সালের সেপ্টেম্বরে সিমলায় (Shimla) এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা-সংক্রান্ত সম্মেলনের আয়োজন করেন।


সম্মেলনের আহ্বানের উদ্দেশ্যঃ

সিমলা সম্মেলন আহ্বানের মূল উদ্দেশ্য ছিল —“ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বল দিকগুলি নিরূপণ করে শিক্ষার মান উন্নয়নের নামে সরকারী নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করা।”

কিন্তু প্রকৃত অর্থে, কার্জনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিলভারতীয় শিক্ষার মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী চেতনা দমন করা,বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা।

অর্থাৎ, বাহ্যত এটি “শিক্ষা সংস্কার সম্মেলন” হলেও, অন্তরালে ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য —

জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দুর্বল করা এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা দৃঢ় করা।

 

উপস্থিত সদস্যবৃন্দঃ এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সিমলায় 1901 সালের সেপ্টেম্বরে। এতে উপস্থিত ছিলেন—ভারতের সমস্ত প্রাদেশিক শিক্ষা অধিকর্তা (Directors of Public Instruction - DPI), কিছু উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা,এবং কেবলমাত্র একজন ইউরোপীয় শিক্ষাবিদ — ডঃ মিনার (Dr. Minar)। কোনও ভারতীয় শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক বা সমাজনেতাকে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এটি ভারতের শিক্ষিত সমাজের মধ্যে গভীর অসন্তোষের জন্ম দেয়।


আলোচিত বিষয় ও গৃহীত প্রস্তাবসমূহঃ

এই সম্মেলনে মোট ৩০টি প্রস্তাব (Resolutions) গৃহীত হয়েছিল, যা পরে ১৯০২ সালের র‌্যালি কমিশন (Raleigh Commission) এবং ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন (Indian Universities Act)-এর ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

প্রধান আলোচিত বিষয়সমূহঃ

(১) শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের পুনর্বিন্যাস - কার্জনের মতে, ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় “অসামঞ্জস্য ও ভারসাম্যের অভাব” ছিল।তিনি বলেন— “Too much attention has been given to higher education and too little to primary education.”

অর্থাৎ, প্রাথমিক শিক্ষার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যা ভারসাম্য নষ্ট করেছে।

তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন, কিন্তু লক্ষ্য ছিল —প্রাথমিক স্তরে “নিষ্ঠাবান কর্মচারী” তৈরি করা, না যে “চিন্তাশীল নাগরিক” গড়ে তোলা।


(২) শিক্ষায় সরকারী নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি   কার্জন মনে করতেন, শিক্ষাব্যবস্থা সরকারী কর্তৃত্বাধীন না হলে “অরাজকতা ও জাতীয়তাবাদী প্রভাব” বৃদ্ধি পাবে।

তাই তিনি বলেন, “Education in India must be kept under the strict control of the Government.”

এজন্য তিনি প্রস্তাব করেন—

প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের উপর সরকারী তত্ত্বাবধান বাড়ানো হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সরকারী কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।


(৩) শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শৃঙ্খলা

সম্মেলনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ্যক্রম এবং শিক্ষার্থীর আচরণের উপর কড়া নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রস্তাব করা হয়।কার্জন বলেন—“Education must not become a means of political agitation.”

অর্থাৎ, শিক্ষা যেন রাজনৈতিক আন্দোলনের অস্ত্র না হয়, বরং সরকারনিষ্ঠ নাগরিক তৈরির উপকরণ হয়।


(৪) বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠন  কার্জন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে “Exam Factory” আখ্যা দিয়ে বলেন,-- “Universities in India are mere examining bodies and have ceased to be teaching centers.”

তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রশাসন ও পাঠদানের কাঠামো পরিবর্তনের প্রস্তাব দেন, যাতে শিক্ষায় “গবেষণা ও মানোন্নয়ন” বাড়ে — কিন্তু একইসাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যেন সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে। এই প্রস্তাবগুলি থেকেই পরবর্তীতে তৈরি হয় ১৯০২ সালের বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন এবং ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন।


(৫) দেশীয় ভাষা ও শিক্ষার প্রশ্নে মনোভাব   কার্জন দেশীয় ভাষার শিক্ষা সম্পর্কে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন।তিনি মনে করতেন, ইংরেজি শিক্ষাই “উন্নতির পথ”, কারণ এটি “সরকারি প্রশাসনের ভাষা”।তাই দেশীয় ভাষায় উচ্চশিক্ষা দেওয়ার কোনও প্রস্তাব তিনি সমর্থন করেননি।


সম্মেলনের ৩০টি প্রস্তাবের সারাংশঃ

1. শিক্ষায় সরকারী তত্ত্বাবধান বৃদ্ধি করা।

2. বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রশাসন সংস্কার।

3. কলেজ অনুমোদনের (Affiliation) নীতিমালা কঠোর করা।

4. প্রাথমিক ও কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন।

5. শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও বেতন কাঠামো নির্ধারণ।

6. গবেষণামূলক শিক্ষার প্রসার।

7. শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চিন্তা নিয়ন্ত্রণ।


সিমলা সম্মেলনের ফলাফলঃ

1. এই সম্মেলনের ভিত্তিতেই ১৯০২ সালের র‌্যালি কমিশন গঠন করা হয়।

2. সেই কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ১৯০৪ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন (Indian Universities Act) প্রণয়ন হয়।

3. এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

4. শিক্ষাক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা দমনের প্রশাসনিক ভিত্তি তৈরি হয়।

5. ভারতীয় সমাজে সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।


 সমালোচনা ও মূল্যায়নঃ

সমালোচনা:

1. সম্মেলনে কোনও ভারতীয় শিক্ষাবিদ বা প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ না জানানো ছিল গভীর অবমাননা।

2. সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো ছিল একতরফা ও আমলাতান্ত্রিক।

3. শিক্ষার উদ্দেশ্যকে “জাতীয় উন্নয়ন” থেকে সরিয়ে “সরকারি আনুগত্য” এর দিকে সরানো হয়েছিল।

4. প্রকৃত শিক্ষা সংস্কারের পরিবর্তে এটি ছিল জাতীয়তাবাদ দমন নীতি।


মূল্যায়ন: তবুও, সিমলা সম্মেলন ভারতীয় শিক্ষার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়।কারণ এটি থেকেই শুরু হয়— শিক্ষার ওপর ব্রিটিশ সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণের যুগ,এবং পরোক্ষে, ভারতের জাতীয়তাবাদী শিক্ষানীতির জন্ম।


উপসংহারঃ  সিমলা সম্মেলন (1901) ছিল ব্রিটিশ শাসনের “শিক্ষা সংস্কারের ছদ্মবেশে রাজনৈতিক দমননীতি”-র সূচনা। লর্ড কার্জন শিক্ষার উন্নয়নের নামে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে সরকারী যন্ত্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তবে এই সম্মেলন থেকেই ভারতীয় শিক্ষিত সমাজ বুঝতে পারে — শিক্ষা কেবল জ্ঞানের বিষয় নয়, বরং স্বাধীনতার পূর্বশর্ত। এই উপলব্ধিই পরবর্তীতে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের মানসিক ভিতকে আরও দৃঢ় করে।

Comments

Popular posts from this blog

National Education Policy (2020)

Charter Act of 1813 and Its Educational Implication.

National Policy on Education (1968)