Secondary Education Commission (1952-53)
মুদালিয়ার মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন (1952–53)
ভূমিকা
স্বাধীনতা লাভের পরই স্বাধীন ভারতের শিক্ষাবিদগণ উপলব্ধি করেছিলেন যে, সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ প্রদত্ত শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল প্রকৃতির, এই ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা মানুষকে হতে হবে জীবন সংগ্রামে বিধ্বস্ত, সেই হবে মূল্যবোধের দীপশিক্ষা নির্বাপিত এক মানুষ। ফলে ভারতবাসী মেরুদণ্ড খাড়া করে দাঁড়াতে পারবে না, শিক্ষাক্ষেত্রে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হওয়াও তার হবে না। সেদিন ভারতবাসীর কাছে শিক্ষাব্যবস্থা আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল; ওই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে 1948 খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন Central Advisory Board of Education (CABE) অর্থাৎ কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা পর্যদ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. তারাচাঁদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সদস্যবৃন্দ সমস্যার গভীরতা উপলব্ধি করেছিলেন, যেমনটি উপলব্ধি করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের সভাপতি ড. সর্বপল্লী রাধাকুয়াণ। তাই তিনি মন্তব্য করেছিলেন, "Our secondary education remains the weakest link in our educational mechinery and needs urgent reforms."অর্থাৎ, আমাদের শিক্ষাসংক্রান্ত গঠন কৌশলে মাধ্যমিক শিক্ষা দুর্বলতম সংযোগ রেখেছে এবং জরুরি সংস্কারের প্রয়োজন। তাই কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা পর্যদ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠনকল্পে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটি সর্বভারতীয় শিক্ষা কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখে। ওই প্রস্তাব অনুযায়ী তদানীন্তন ভারত। সরকার, মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য ড. লক্ষ্মণস্বামী মুদালিয়ার-এর সভাপতিত্বে 1952 খ্রিস্টাব্দে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন (The Secondary Education Commission, 1952) নামে একটি কমিশন গঠন করে।
সমাধান: 1952 সালে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন গঠন, সভাপতিত্বে ড. লক্ষ্মণস্বামী মুদালিয়ার।
সদস্যরা:
ভারতীয়: ড. অনাথ নাথ বসু, শ্রীমতী হংসরাজ মেহেতা, ড. কে. এল. শ্রীমালী প্রমুখ
বিদেশি: জন কিস্টি (অক্সফোর্ড), ড. কিলেও রাস্ট উইলিয়াম (USA)
মাধ্যমিক শিক্ষার ত্রুটিসমূহ
1. বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন
2. সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি → চরিত্র ও মানসিক বিকাশ ব্যর্থ
3. মাতৃভাষা অবহেলা, ইংরেজি অতিরিক্ত গুরুত্বপ্রাপ্ত
4. যান্ত্রিক শিক্ষণ পদ্ধতি → মুখস্থ বিদ্যা
5. ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতি
6. বিদ্যালয় সংখ্যা কম → শিক্ষার্থীর মনোযোগ বিভ্রান্ত
7. সমাজের সঙ্গে অভিযোজন ব্যর্থ
8. আত্মসক্রিয়তা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব
মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য
1. জাতীয় সম্পদের উন্নয়ন: শিক্ষার্থীর যোগ্যতা → দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি
2. যোগ্য নাগরিক সৃষ্টি: গণতান্ত্রিক দায়িত্ব বহনযোগ্য নাগরিক
3. সংস্কৃতি ও নেতৃত্ব বিকাশ: সংস্কৃতি সচেতন ও নেতৃত্ব গ্রহণযোগ্য শিক্ষার্থী
4. চরিত্র ও আত্মনির্ভরশীলতা: নৈতিক ও আত্মনির্ভর শিক্ষার্থী
5. বৃত্তিমূলক দক্ষতা: প্রযুক্তিগত ও সামাজিক দক্ষতা
6. বয়ঃসন্ধিকাল উপযোগী শিক্ষা: মানসিক ও দৈহিক পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ
7. প্রাকৃতিক সম্পদ ও সংগতিবিধান শিক্ষা
শিক্ষার কাঠামো
মুদালিয়ার প্রস্তাবিত 12/11 বছরের কাঠামো: প্রাথমিক,নিম্ন মাধ্যমিক,উচ্চ মাধ্যমিক
প্রস্তাবিত 4–5 বছর 3–4 বছর 3–4 বছর
নোট: পূর্বের “ইনটারমিডিয়েট” স্তর বিলুপ্ত, বাধ্যতামূলক শিক্ষা 14 বছর পর্যন্ত।
ভাষা ও পাঠ্যক্রম নীতি
ত্রিভাষা নীতি:
1. মাতৃভাষা/আঞ্চলিক ভাষা
2. হিন্দি
3. ইংরেজি
পাঠ্যক্রম: বাস্তবধর্মী, আগ্রহভিত্তিক, বহুমুখী
কার্যক্রম: শ্রেণিকক্ষ, গ্রন্থাগার, ল্যাব, ওয়ার্কশপ, খেলার মাঠ
মূল নীতি: বৈচিত্র্য, সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা, অবসর-মনোরঞ্জন অন্তর্ভুক্ত
আবশ্যিক বা মূল অংশে থাকবে-
1. ভাষা (Language): এখানে দুটি ভাষা শিক্ষার্থীদের শিখতে হবে।
(a) মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা বা মাতৃভাষা এবং প্রাচীন ভাষার মিশ্রণ।
(b) নিম্নলিখিত ভাষাগুলি থেকে যে-কোনো একটি-
(i) হিন্দি (যাদের মাতৃভাষা হিন্দি নয় তাদের);
(ii) প্রাথমিক ইংরেজি (ইংরেজি যারা পূর্বে পড়েনি);
(iii) ইংরেজি (যারা পূর্ব স্তরে ইংরেজি পড়েছে);
(iv) হিন্দি ছাড়া একটি আধুনিক ভারতীয় ভাষা;
(v) ইংরেজি ছাড়া একটি আধুনিক ইউরোপীয় ভাষা;
(vi) একটি প্রাচীন ভাষা।
2. সমাজ বিজ্ঞান (Social Science): [প্রথম দু-বছরের জন্য সাধারণ পাঠ]
3. সাধারণ বিজ্ঞান ও গণিত (General Science & Mathematics): [প্রথম দু-বছরের জন্য। সাধারণ পাঠ্য
4. হস্তশিল্প (Craft): নিম্নলিখিত বিষয়গুলির মধ্য থেকে যে-কোনো একটি-বয়ন বা বুনন, কাঠের কাজ, ধাতুর কাজ, উদ্যান রচনা, দর্জির কাজ, টাইপোগ্রাফি, কর্মশালায় প্রস্তুতিমূলক কাজ, সেলাই ও সূচিশিল্প, মূর্তি শিল্প ইত্যাদি।
পরীক্ষা ও মূল্যায়ন
1. বহিঃপরীক্ষা হ্রাস, নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নপত্র প্রাধান্য
2. গ্রেডিং ব্যবস্থা (A, B, C, D)
3. স্কুল রেকর্ড → শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন চিত্র
কারিগরি ও শারীরিক শিক্ষা
কারিগরি বিদ্যালয় বৃদ্ধি, All India Council of Technical Education দ্বারা সমন্বয়
শারীরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক, সুস্থ নাগরিক গঠনের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্যে সংস্থা
শিক্ষক উন্নয়ন
যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ, পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, জীবনবিমা
অবসর 60 বছর, সন্তান বিনামূল্যে স্কুলে শিক্ষা
প্রশিক্ষণকাল: স্নাতক → 1 বছর, মাধ্যমিক → 2 বছর
নারীশিক্ষা ও সহশিক্ষা
গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, সংগীত, চারুকলা, সুজল শিল্প
Girls’ School সম্ভব না হলে, Co-education → শিক্ষার মান নিশ্চিত
স্কুল প্রশাসন ও অর্থায়ন
বিদ্যালয় পরিদর্শন, পরিচালনা সমিতি, ছাত্রসংখ্যা সীমা (30–40/শ্রেণি)
কেন্দ্রীয় অর্থায়ন, কর ও ফান্ড ব্যবস্থার সুপারিশ
বহুমুখী বিদ্যালয়সমূহ (Multipurpose Schools)
মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন বহুমুখী বিদ্যালয় (Multipurpose Schools) প্রতিষ্ঠার জন্য সুপারিশ করেছে। কমিশনের মতে, বহুমুখী বিদ্যালয়গুলিতে যে সাধারণ শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে তাতে শিক্ষার্থীরা মানসিক তৃপ্তি পাবে, মূল্যবোধের বিকাশ ঘটবে। তারা নিজ নিজ সামর্থ্য, বুচি, প্রবণতা অনুযায়ী শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পাবে। নির্বাচিত পাঠ্যক্রম তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের পথপ্রদর্শক হয়ে কাজ করবে, অনুপ্রেরণা দেবে। বহুমুখী বিদ্যালয় (Multipurpose Schools) যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে বেশ কিছু শিক্ষার্থী সাধারণ শিক্ষা (General Education) থেকে সরে আসবে। বৃত্তিমূলক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। তাত্ত্বিক জ্ঞানের সঙ্গে ব্যবহারিক জ্ঞানের সমন্বয়ে শিক্ষার্থীদের যথার্থ বিকাশ ঘটবে, তাদের চিন্তনশক্তি, বিচারশক্তি, যুক্তিশক্তি বৃদ্ধি পাবে, বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তির পথ তারা খুঁজে পাবে।তাই মুদালিয়ার কমিশন শিক্ষার্থীদের তথা দেশের স্বার্থরক্ষার্থে বৃত্তিশিক্ষার ওপর যথেষ্ট গুরত্ব দিয়েছেন। কমিশন স্বাতন্ত্র্যভাবে বা বহুমুখী বিদ্যালয়গুলির সঙ্গে কারিগরি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছেন। এক্ষেত্রে কারিগরি বিদ্যালয়গুলির উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি সর্বভারতীয় কারিগরি শিক্ষা পর্ষদ (All India Council for Technical Education বা AICTE) গঠনের সুপারিশও কমিশন করেছেন। মুদালিয়ার কমিশনের রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, সব রাজ্যের গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলিতে কৃষি-শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ, বৃত্তিমুখী শিক্ষা এবং উৎপাদনমুখী শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষতাসম্পন্ন নাগরিক তৈরি করার মানসে এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে।
উপসংহার
মুদালিয়ার কমিশন শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণে এবং কাঠামো ও পাঠ্যক্রম পুনর্গঠনে একটি দিকনির্দেশ প্রদান করেছে। এটি শিক্ষার্থীকে যোগ্য নাগরিক, দক্ষ ও আত্মনির্ভর ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়াসী।
Comments
Post a Comment