Sargent Plan 1944
সার্জেন্ট রিপোর্ট(The Sargent Report, 1944)
ভূমিকা (Introduction)
১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্যায়ে ভারতের শিক্ষা সম্পর্কে একটি যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন পরিকল্পনা (Post-War Reconstruction) প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।এই উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ড (Central Advisory Board of Education - CABE) গঠন করে একটি কমিটি, যার সভাপতি ছিলেন স্যার জন সার্জেন্ট (Sir John Sargent) — যিনি তখন ভারতের শিক্ষা সচিব (Educational Adviser to the Government of India) ছিলেন।
১৯৪৪ সালে কমিটি যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে তা “Report on Post-War Educational Development in India” নামে পরিচিত — ইতিহাসে একে সাধারণভাবে বলা হয় Sargent Report (সার্জেন্ট রিপোর্ট)।
প্রধান উদ্দেশ্য (Objectives of the Report)
1. ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা যেন ইংল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থার সমমানের হয়, সেই লক্ষ্য নিয়ে পরিকল্পনা করা।
2. শিক্ষার মান, গুণগত উন্নয়ন ও প্রশাসনিক সমন্বয় সাধন।
3. শিশু, কিশোর, প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সমন্বিত শিক্ষা সুযোগ সৃষ্টি।
4. ৪০ বছরের মধ্যে (1984 সালের মধ্যে) ভারতকে সার্বিক শিক্ষিত দেশে পরিণত করা।
রিপোর্টের মূল বৈশিষ্ট্য ও প্রস্তাবসমূহ (Main Features and Recommendations)
১️.শিশুশিক্ষা বা প্রাথমিক শিক্ষা (Pre-primary and Primary Education)
৩–৬ বছর বয়স:
প্রতিটি গ্রামের জন্য নার্সারি স্কুল (Nursery School) স্থাপন।
খেলাধুলা, গান, ছবি, গল্প ইত্যাদির মাধ্যমে আনন্দমুখর শিক্ষা।
৬–১৪ বছর বয়স:
বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা (Free and Compulsory Education)
দুটি ধাপে বিভক্ত —
Junior Basic (৬–১১ বছর)
Senior Basic (১১–১৪ বছর)
শিক্ষার মাধ্যমে শ্রম, শৃঙ্খলা ও নৈতিক গুণাবলির বিকাশ।
মাতৃভাষা হবে শিক্ষার মাধ্যম।
প্রতিটি শ্রেণিতে ৩০ জন ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষক।
মেয়েদের শিক্ষায় বিশেষ জোর।
২️.মাধ্যমিক শিক্ষা (Secondary Education)
মেয়াদ: ৬ বছর (১১–১৭ বছর)
দুটি ধরণে বিভক্ত —
Academic High School – সাধারণ শিক্ষা (Arts, Science)।
Technical High School – কারিগরি ও ব্যবহারিক শিক্ষা।
শিক্ষার শেষে দুই ধাপ:
Middle School Examination (14 বছর)
School Leaving Examination (17 বছর)
ইংরেজি হবে দ্বিতীয় ভাষা।
কারিগরি বিষয় ও হস্তশ্রমকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাতে শিক্ষার্থীরা পেশাভিত্তিক জীবন গড়তে পারে।
৩️. উচ্চশিক্ষা (Higher Education)
কলেজে ভর্তি হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে (Merit-based Admission)।
ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণি (Intermediate) বাতিল করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় কোর্স হবে তিন বছরের ডিগ্রি (Three-year Degree Course)।
শিক্ষার বিষয় নির্বাচন হবে স্বাধীনভাবে।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ, গবেষণা, গ্রন্থাগার ও ছাত্রাবাস ব্যবস্থার উন্নয়ন।
University Grants Committee (UGC)-এর মতো সংস্থা গঠনের প্রস্তাব – যাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মান রক্ষা ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণামূলক কেন্দ্র (Research-oriented institutions) হিসেবে গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়।
৪️.কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা (Technical and Vocational Education)
দ্রুত শিল্পোন্নয়নের জন্য কারিগরি শিক্ষাকে অপরিহার্য বলে বিবেচনা।
প্রস্তাবিত স্তরসমূহ —
1. Junior Technical School
2. Trade School
3. Polytechnic
4. Technical College
5. Engineering College
6. Technological University
7. Research Institute
কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি বয়স: ১৫ বছর থেকে।
শিল্প ও বাণিজ্যের সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার সংযোগ স্থাপন।
৫️.বয়স্ক শিক্ষা (Adult Education)
১০–৪০ বছর বয়সের নিরক্ষর জনগণকে শিক্ষা প্রদান।
শিক্ষা হবে আনন্দদায়ক ও ব্যবহারিক — যেমন: কৃষি, স্বাস্থ্য, সামাজিক জীবন, নাগরিকতা ইত্যাদি।
রেডিও, সিনেমা, পুস্তিকা, নাটক ইত্যাদি ব্যবহার করে প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষা দেওয়া।
৬️.প্রতিবন্ধী ও বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা (Education of the Handicapped)
দৃষ্টি, শ্রবণ ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ স্কুল স্থাপন।
সরকারি তত্ত্বাবধানে এই শিক্ষা চলবে।
তাদের কর্মসংস্থানের জন্য Employment Bureau স্থাপনের প্রস্তাব।
৭️. শিক্ষক প্রশিক্ষণ (Teacher Education)
শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভাগ গঠন।
Refresher Course বা পুনঃপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।
প্রাথমিক স্তরে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ৩০:১, মাধ্যমিক স্তরে ২৫:১ নির্ধারণ।
শিক্ষকদের মর্যাদা, বেতন ও সুযোগসুবিধা বৃদ্ধির প্রস্তাব।
৮️.শিক্ষা প্রশাসন (Educational Administration)
কেন্দ্রীয় শিক্ষা বিভাগ (Central Department of Education) শক্তিশালী করা।
কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ।
All India Education Service (AIES) গঠনের সুপারিশ।
National Board of Education স্থাপন করে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও মান রক্ষার প্রস্তাব।
সার্জেন্ট পরিকল্পনার সময়সীমা ও ব্যয় (Time Frame and Finance)
রিপোর্ট অনুযায়ী, ৪০ বছরের মধ্যে (১৯৮৪ সালের মধ্যে) সমস্ত শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দিতে হবে।প্রস্তাবিত বার্ষিক ব্যয় প্রায় ₹৩০০ কোটি টাকা, যা তৎকালীন ভারতের পক্ষে অসম্ভব ছিল।
সমালোচনা (Criticisms)
1. অবাস্তব ব্যয়বহুল পরিকল্পনা: তৎকালীন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত বাজেট অগ্রহণযোগ্য।
2. অত্যন্ত দীর্ঘ সময়সীমা: ৪০ বছর সময় নির্ধারণ করে পরিকল্পনাটিকে অকার্যকর করে তোলে।
3. ইউরোপকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি: পরিকল্পনাটি ইংল্যান্ডের শিক্ষার অনুকরণে তৈরি, ভারতের বাস্তবতা উপেক্ষিত।
4. বৈষম্যপূর্ণ কাঠামো: শহর ও গ্রাম, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে শিক্ষাগত ফারাক রয়ে যায়।
5. অতিরিক্ত সরকারি নিয়ন্ত্রণ: শিক্ষা প্রশাসনে সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা সীমিত করে।
মূল্যায়ন (Evaluation and Significance)
1. এটি ছিল ভারতের প্রথম সমন্বিত জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনা (First Comprehensive National Educational Plan)।
2. পরবর্তী রাধাকৃষ্ণন কমিশন (1948–49) ও মুদ্রাল কমিশন (1952) এই রিপোর্টের ভিত্তিতে গঠিত হয়।
3. সার্জেন্ট রিপোর্ট ভারতীয় শিক্ষায় গঠনমূলক ভাবনা ও দিকনির্দেশনা দেয়।
4. স্বাধীন ভারতের শিক্ষা পুনর্গঠনের মূল ভিত্তি হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
5. জাতীয় শিক্ষার চেতনা জাগ্রত করতে এটি সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
উপসংহার (Conclusion)
সার্জেন্ট রিপোর্ট ছিল ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে এক মাইলফলক। যদিও এটি অবাস্তব ও ব্যয়বহুল ছিল, তবু এর আদর্শবাদী রূপরেখা স্বাধীন ভারতের শিক্ষানীতিকে দিকনির্দেশ দেয়।এর ফলেই পরবর্তীকালে আমরা 1948 সালের বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন, 1968 ও 1986 সালের জাতীয় শিক্ষানীতি, এমনকি NEP 2020 পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে পরিকল্পিত শিক্ষার পথে অগ্রসর হয়েছি।
Comments
Post a Comment