Sadler Commission & Calcutta University Commission 1917

 স্যাডলার কমিশন (Calcutta University Commission, 1917–1919)

 ভূমিকা (Introduction)

ভারতের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার বিকাশে স্যাডলার কমিশন একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। এটি কেবল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার নিয়েই কাজ করেনি, বরং সমগ্র ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার গঠন, দিকনির্দেশ ও দর্শন নির্ধারণে মৌলিক অবদান রাখে। এর প্রতিবেদন ভারতের আধুনিক শিক্ষানীতির ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে বিবেচিত।

 পটভূমি (Background)

উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ও বিংশ শতাব্দীর সূচনায় ভারতের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা নানা সংকটে নিমজ্জিত হয়।লর্ড কার্জনের 1904 সালের বিশ্ববিদ্যালয় আইন (Indian Universities Act, 1904) প্রশাসনিক সংস্কার আনলেও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে ব্যর্থ হয়।১৯১০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠন ভারতীয় শিক্ষাবিদদের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে, এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠনের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে।১৯১৩ সালে সরকার ঘোষণা করে যে, ভারতের বিদ্যমান একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় এবং সীমিতসংখ্যক কলেজ দেশের উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণে অসমর্থ।কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (1914–1918) কারণে সেই উদ্যোগ বিলম্বিত হয়।অবশেষে ১৯১৭ সালে, ভারত সরকার “কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন” (Calcutta University Commission) নিয়োগ করে, যার নেতৃত্বে ছিলেন স্যার মাইকেল স্যাডলার।


 কমিশনের গঠন (Composition of the Commission)

সভাপতি (Chairman): স্যার মাইকেল আর্নেস্ট স্যাডলার (Vice-Chancellor, University of Leeds)

সদস্যবৃন্দ:  স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (Vice-Chancellor, Calcutta University), স্যার জিয়াউদ্দিন আহমদ,  ড. গ্রেগরি, প্রফেসর র‍্যামজে মুর,স্যার ফিলিপ হার্টগ,এবং আরও কয়েকজন ব্রিটিশ ও ভারতীয় শিক্ষাবিদ

কমিশন ১৭ মাসব্যাপী (১৯১৭–১৯১৯) সমগ্র ভারত পরিভ্রমণ করে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, অধ্যাপক ও ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে।


 উদ্দেশ্য (Objectives)

সরকারি ঘোষণাপত্র অনুযায়ী কমিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল—

“To enquire into the condition and prospects of the University of Calcutta and to consider the question of a constructive policy in relation to the question it presents.”

অর্থাৎ,, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা, কার্যক্রম, প্রশাসন ও শিক্ষার মান পর্যালোচনা করে তার সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য বাস্তবসম্মত নীতি প্রণয়ন করা।

কিন্তু বাস্তবে, স্যাডলার কমিশন কেবল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং সমগ্র ভারতের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কেই দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করে।


কমিশনের প্রধান সুপারিশসমূহ (Major Recommendations)

১️.মাধ্যমিক শিক্ষা (Secondary Education)

ত্রুটি:

অপ্রশিক্ষিত শিক্ষক, কম বেতন ও অপ্রতুল পরিকাঠামো

পাঠ্যসূচির অপ্রাসঙ্গিকতা ও অযৌক্তিকতা

সরকারি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ

পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তার অভাব

সুপারিশ:

কলেজের প্রথম দুই বছরের পাঠ্যক্রম বাদ দিয়ে সেটিকে মাধ্যমিক স্তরের সঙ্গে যুক্ত করে “ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষা” (Intermediate Education) নামে নতুন স্তর প্রবর্তন।

মাধ্যমিক শিক্ষা হবে দুই ধাপে বিভক্ত—

1. ম্যাট্রিকুলেশন (১০ম শ্রেণি পর্যন্ত)

2. ইন্টারমিডিয়েট (১২ম শ্রেণি পর্যন্ত)

মাধ্যমিক ও ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষার তত্ত্বাবধানে পৃথক বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশন গঠন।

মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রবর্তন (ইংরেজি ও গণিত ব্যতীত)।

মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকার থেকে বার্ষিক ৪০ লক্ষ টাকা অনুদানের প্রস্তাব।


2. বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা (University Education)

ত্রুটি:

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজে অতিরিক্ত জটিলতা

কলেজগুলির আর্থিক দুর্বলতা ও নিম্নমানের শিক্ষক বেতন

গবেষণা ও ছাত্রকল্যাণ কার্যক্রমের অভাব

পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা


সুপারিশ: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি শিক্ষণ ও গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পুনর্গঠন।

ঢাকায় একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় (Residential University) প্রতিষ্ঠার সুপারিশ।

B.A. কোর্সের মেয়াদ ২ বছর থেকে ৩ বছর করা।

শিক্ষাদান হবে টিউটোরিয়াল, আলোচনা ও ছাত্র–শিক্ষক মিথস্ক্রিয়াভিত্তিক।

অনার্স ও পোস্টগ্রাজুয়েট স্তরের শিক্ষার সম্প্রসারণ।

ভারতীয় ভাষার চর্চা ও গবেষণায় উৎসাহ প্রদান।


৩️. প্রশাসনিক সংস্কার (Administrative Reforms)

বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে আংশিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।

সেনেট ও সিন্ডিকেটের পরিবর্তে কোর্ট ও এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল গঠন।

পাঠ্যক্রম নির্ধারণের জন্য ফ্যাকাল্টি ও বোর্ড অব স্টাডিজ স্থাপন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপার্টমেন্ট অফ এডুকেশন প্রতিষ্ঠা।

ছাত্রকল্যাণের জন্য স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল গঠন।

শারীরিক ও নৈতিক শিক্ষার জন্য Director of Physical Education নিয়োগের প্রস্তাব।


৪️. নারী শিক্ষা (Women’s Education)

নারীদের শিক্ষার জন্য বিশেষ স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা।

পর্দানশীন নারীদের জন্য বিশেষ “পর্দা স্কুল” স্থাপনের পরামর্শ।

নারী শিক্ষার জন্য পৃথক বোর্ড গঠন ও উপযুক্ত পাঠ্যসূচি প্রণয়ন।


৫️. বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা (Vocational and Technical Education)

উচ্চশিক্ষার সঙ্গে বৃত্তিমূলক ও কারিগরি প্রশিক্ষণের সংযোগ ঘটাতে হবে।

বিজ্ঞান, শিল্প, কৃষি ও ব্যবসায়িক শিক্ষাকে সম্প্রসারিত করতে হবে।


৬️. আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বোর্ড (Inter-University Board)

ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যোগাযোগ, মতবিনিময় ও সমন্বয়ের জন্য একটি Inter-University Board গঠনের প্রস্তাব।

এই বোর্ডের ধারাবাহিক বিকাশ পরবর্তীকালে Association of Indian Universities (AIU) রূপে আত্মপ্রকাশ করে।


 মূল্যায়ন ও সমালোচনা (Evaluation and Criticism)

সাফল্য ও প্রভাব:

1. স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ইন্টারমিডিয়েট বোর্ড ও তিন বছরের বিএ কোর্স চালু হয়।

2. মাধ্যমিক শিক্ষা প্রথমবারের মতো স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামো পায়

3. বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিপার্টমেন্টাল শিক্ষা, টিউটোরিয়াল পদ্ধতি এবং ছাত্রকল্যাণ পরিষদ চালু হয়।

4. মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রচলন জোরদার হয়।

5. বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কার আজও এই প্রতিবেদনের ছায়াতেই চলছে।


 সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা:

1. কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে উচ্চ ব্যয়ের কারণে অনেক পদক্ষেপ স্থগিত থাকে।

2. ঢাকার আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।

3. ধর্মভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে।

4. শিল্প ও কারিগরি শিক্ষার বিকাশে প্রস্তাব কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।


 ঐতিহাসিক গুরুত্ব (Historical Significance)

স্যাডলার কমিশনের প্রতিবেদন ভারতের শিক্ষানীতির ইতিহাসে এক মৌলিক দলিল।

এটি প্রথমবার শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটি সমন্বিত কাঠামো হিসেবে দেখেছিল — যেখানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত।

মেহিউ (Mayhew) যথার্থই বলেছেন —

“The Report of the Calcutta University Commission has been a constant source of suggestion and information. Its significance in the history of Indian Education is incalculable.”


 উপসংহার (Conclusion)

স্যাডলার কমিশনের প্রস্তাব কেবল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোই নয়, ভারতের উচ্চশিক্ষার দর্শনকেও পুনর্নির্মাণ করে।এর প্রভাব পরবর্তী ১৯২০–১৯৪৭ সালের শিক্ষানীতি, বিশ্ববিদ্যালয় আইন ও বিশ্ববিদ্যালয় মডেল-এ প্রতিফলিত।অতএব, স্যাডলার কমিশনকে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসে এক “অমর নির্দেশিকা” বলা যেতে পারে।

Comments

Popular posts from this blog

National Education Policy (2020)

Charter Act of 1813 and Its Educational Implication.

National Policy on Education (1968)