Indian Education Commission or Hunter Commission 1882
হান্টার কমিশন (Hunter Commission) 1882
ভূমিকা ও প্রেক্ষাপট:
১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে উডের ডেসপ্যাচের (Wood’s Despatch) মাধ্যমে ভারতে শিক্ষাব্যবস্থার একটি ভিত্তি স্থাপিত হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে দেখা যায়, সেই ডেসপ্যাচে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর যতটা জোর দেওয়া হয়েছিল, বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। সরকারি মনোযোগ কেবল উচ্চশিক্ষা ও কলেজ প্রতিষ্ঠার দিকেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতি একেবারেই হয়নি।
এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও শিক্ষানীতির ত্রুটি নিরূপণের জন্য ১৮৮২ সালে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড রিপন (Lord Ripon) “ভারতীয় শিক্ষা কমিশন (Indian Education Commission)” গঠন করেন।
এই কমিশনের সভাপতি ছিলেন স্যার উইলিয়াম হান্টার (Sir William Hunter), তাই এটি ইতিহাসে হান্টার কমিশন নামে পরিচিত হয়।
কমিশনের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন:
সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মাসুদ,
ভূপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়,
আনন্দমোহন বসু,
কাশীনাথ তেলং,
জ্যোতীন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রমুখ।
কমিশন ১৮৮৩ সালে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা ছিল প্রায় ৬০০ পৃষ্ঠার এবং এতে মোট ২২২টি প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কমিশনের উদ্দেশ্য:
১. উডের ডেসপ্যাচে নির্ধারিত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা।
২. প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা ও এর বিস্তার মূল্যায়ন করা।
৩. সরকার ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক নির্ধারণ করা।
৪. মাধ্যমিক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার মানোন্নয়ন ও প্রসারের সুপারিশ করা।
হান্টার কমিশনের প্রধান সুপারিশসমূহ:
(A) দেশীয় শিক্ষা: কমিশন ভারতীয় জনগণের নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দেশীয় বিদ্যালয়গুলিকে উৎসাহিত করার কথা বলে।এই বিদ্যালয়গুলিকে সরকার “অনুদান নীতি (Grant-in-Aid)”-এর আওতায় আনবে।এসব বিদ্যালয়ের উন্নয়ন, তদারকি ও পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে স্থানীয় সংস্থা (Municipal Board ও District Board)-এর হাতে।ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার পক্ষে কমিশন দৃঢ় মত প্রকাশ করে।
(B) প্রাথমিক শিক্ষা:
১. প্রশাসনিক সুপারিশ: প্রতিটি জেলা বোর্ড বা পৌরসভা (Municipal Board) তাদের নিজস্ব এলাকায় বিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করবে।সরকার ধীরে ধীরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দায়িত্ব স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলির হাতে তুলে দেবে।প্রতিটি বোর্ড প্রাথমিক শিক্ষার জন্য আলাদা তহবিল গঠন করবে।সরকার শিক্ষাখাতে বরাদ্দ অর্থের এক-তৃতীয়াংশ প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যয় করবে।
২. পাঠ্যসূচি সংক্রান্ত সুপারিশ: পাঠ্যসূচি হবে জীবনমুখী ও ব্যবহারিক।বিষয়সমূহ: গণিত, হিসাবরক্ষণ, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, শরীরবিজ্ঞান, জমি জরিপ, হস্তশিল্প, কৃষি ইত্যাদি।প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা।দৈহিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে বলা হয় (ব্যায়াম, ক্রীড়া ইত্যাদি)।
৩. অন্যান্য বিষয়: প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে বেতন গ্রহণ করা যেতে পারে, তবে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা দিতে হবে।প্রতিটি জেলায় নর্মাল স্কুল (শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র) স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।
(C) মাধ্যমিক শিক্ষা:
১. প্রশাসন: মাধ্যমিক শিক্ষা ধীরে ধীরে বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দিতে হবে।তবে প্রতিটি জেলায় একটি করে “সরকারি আদর্শ বিদ্যালয় (Model School)” থাকবে, যাতে শিক্ষার মান বজায় থাকে।অনগ্রসর অঞ্চলে সরকার নিজেই বিদ্যালয় স্থাপন করবে।
২. পাঠ্যক্রম: কমিশন পাঠ্যক্রমকে দুটি ভাগে বিভক্ত করার পরামর্শ দেয়—
A কোর্স: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার প্রস্তুতিমূলক তাত্ত্বিক পাঠ্যসূচি।
B কোর্স: ব্যবহারিক বা বৃত্তিমূলক শিক্ষা যেমন—কারুশিল্প, কৃষি, প্রযুক্তি ইত্যাদি।
অষ্টম শ্রেণির পর শিক্ষার্থীরা নিজেদের ইচ্ছানুসারে “A” বা “B” কোর্স বেছে নিতে পারবে।
৩. শিক্ষার মাধ্যম:কমিশন এই বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু বলেনি, তবে ইংরেজি ভাষাকে মাধ্যমিক শিক্ষার প্রধান ভাষা হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়।তবে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে রাজ্যগুলিকে নিজেদের অবস্থান অনুযায়ী স্থানীয় ভাষা ব্যবহারের স্বাধীনতা দেওয়া হয়।
৪. শিক্ষক প্রশিক্ষণ:প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি নর্মাল স্কুল স্থাপন করার কথা বলা হয়।শিক্ষক নিয়োগের আগে শিক্ষাতত্ত্ব ও শিক্ষণতত্ত্বের পরীক্ষা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষককে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়।
৫. অর্থ ও অনুদান:বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিকে অনুদান প্রদান করে উৎসাহিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়।বিদ্যালয়ের বেতন কাঠামো নির্ধারণের স্বাধীনতা পরিচালন সমিতির হাতে থাকবে।
(D) নারী শিক্ষা: বেসরকারি বালিকা বিদ্যালয়গুলিকে সরকারি অনুদান দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।নারী শিক্ষার তদারকির জন্য মহিলা পরিদর্শিকা নিয়োগের কথা বলা হয়।মেয়েদের জন্য আবাসিক বিদ্যালয় ও নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয়।মেধাবী ছাত্রীদের বৃত্তি (Scholarship) প্রদানের সুপারিশ করা হয়।
(E) মুসলিম শিক্ষা:মুসলমানদের জন্য পৃথক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মক্তব ও মাদ্রাসা) স্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয়।মুসলিম শিক্ষকদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।তাদের পশ্চিমা শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করতে বিশেষ প্রচেষ্টার সুপারিশ করা হয়।
(F) উচ্চশিক্ষা: যদিও এই কমিশনের মূল লক্ষ্য ছিল প্রাথমিক শিক্ষা, তবুও উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত কিছু প্রস্তাব করা হয়—
১. কলেজ শিক্ষার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস করা।
২. বেসরকারি কলেজ স্থাপনে উৎসাহ দেওয়া।
৩. মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তি প্রদান।
৪. উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
হান্টার কমিশন (১৮৮২): মাধ্যমিক শিক্ষা সংক্রান্ত সুপারিশ
প্রশাসন সংক্রান্ত সুপারিশ
১. সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস: মাধ্যমিক শিক্ষা থেকে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে বেসরকারি কর্তৃপক্ষের হাতে দায়িত্ব অর্পণ। সরকার শুধুমাত্র আর্থিক সাহায্য (গ্রান্ট-ইন-এইড) দেবে।
২. পশ্চাৎপদ এলাকার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা: দরিদ্র ও অনগ্রসর অঞ্চলের স্কুলগুলি সরকারি বিভাগের পরিচালনায় রাখা হবে।
৩. আদর্শ স্কুল স্থাপন: শিক্ষার মান বজায় রাখার জন্য প্রতিটি জেলায়, একটি করে উন্নত মানের আদর্শ স্কুল সরকারি পরিচালনায় রাখার সুপারিশ।
৪. ইচ্ছাভিত্তিক স্কুল স্থাপন: কোনো অঞ্চলের জনগণ আগ্রহী না হলে সরকার জোর করে সেখানে স্কুল স্থাপন করবে না।
৫. বেতন নির্ধারণের স্বাধীনতা: বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য স্থানীয় পরিচালক সমিতিকে নিজ নিজ স্কুলের বেতনের হার নির্ধারণের স্বাধীনতা দেওয়া।
পাঠ্যক্রম সংক্রান্ত সুপারিশ
দ্বি-শাখা পাঠ্যক্রম প্রবর্তন
হান্টার কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমকে দুটি শাখায় বিভক্ত করার প্রস্তাব করেন:
১. এ-কোর্স (তাত্ত্বিক শাখা):
· বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতিমূলক
· পুথিগত ও তত্ত্বকেন্দ্রিক শিক্ষা
২. বি-কোর্স (ব্যবহারিক শাখা):
· কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা
· বাণিজ্য ও সাহিত্য বহির্ভূত ব্যবহারিক বিষয়
শিক্ষার্থীদের পছন্দের স্বাধীনতা
· অষ্টম শ্রেণীর পর শিক্ষার্থীরা নিজ ইচ্ছানুসারে এ-কোর্স বা বি-কোর্স বেছে নিতে পারবে।
· কমিশন আশা করেছিল যে ছাত্ররা কলেজের পুথিগত শিক্ষার পরিবর্তে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে বেশি পছন্দ করবে।
বাস্তব চিত্র
· বি-কোর্স গ্রহণে ছাত্ররা তেমন উৎসাহী হয়নি
· কাঠের কাজ, কামারের কাজ শিখতে বিশেষ আগ্রহ দেখা যায়নি
· এ-কোর্সের তুলনায় বি-কোর্সকে ছোট মনে করা হতো
· ড্রয়িং, বিজ্ঞান প্রভৃতি কয়েকটি ব্যবহারিক বিষয় যোগ করা হলেও মৌলিক পরিবর্তন হয়নি
মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যম
· কমিশন ইংরেজি ভাষাকেই মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বহাল রাখার পক্ষে ছিল
· মাধ্যমিক শিক্ষার নিম্নস্তরে শিক্ষার মাধ্যম বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রদেশগুলিকে কিছু স্বাধীনতা দেওয়া হয়
· এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কমিশনের নীরবতা সমালোচনার দাবিদার
উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত সুপারিশ
১. সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার: কলেজীয় শিক্ষার ক্ষেত্র থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার
২. বেসরকারি উদ্যোগে সহায়তা: বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে আরও উদারভাবে আর্থিক সাহায্য প্রদান
৩. সাহায্য নির্ধারণের মানদণ্ড: অধ্যাপকদের বেতন, পরিচালনা ব্যয়, শিক্ষার মান, স্থানীয় উপযোগিতা, গ্রন্থাগার ও গবেষণাগার - এই সব দিক বিবেচনা করে সাহায্যের পরিমাণ নির্ধারণ
৪. সমালোচনাযোগ্য সিদ্ধান্ত: বেসরকারি কলেজে সরকারি কলেজের চেয়ে কম বেতন ধার্য করার অনুমতি দেওয়া, যা অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে
৫. বৃত্তি ও অবৈতনিক শিক্ষা: দুস্থ ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তি ও অবৈতনিক শিক্ষার ব্যবস্থা
৬. নতুন বিশ্ববিদ্যালয়: উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব
শিক্ষক-শিক্ষণ সংক্রান্ত সুপারিশ
১. নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠা: প্রতিটি মহকুমায়, একটি করে নর্মাল স্কুল স্থাপন
২. সরকারি অর্থায়ন: শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য সরকারকেই আর্থিক দায়িত্ব বহন করতে হবে
৩. ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ: শিক্ষকদের ব্যবহারিক শিক্ষণ পদ্ধতি ও শিক্ষানীতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ
৪. স্থায়ী নিয়োগ: প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের স্থায়ীভাবে নিয়োগের ব্যবস্থা
৫. কম সময়সীমা: স্নাতক শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের সময়সীমা কমিয়ে আনা
বিশেষ শিক্ষা সংক্রান্ত সুপারিশ
মুসলিম শিক্ষা
· মুসলমানদের শিক্ষায় পিছিয়ে থাকার কারণে বিশেষ সুবিধা প্রদান
· মুসলিম স্কুলগুলিকে সরকারি সাহায্য
· মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে বেশি সংখ্যক মক্তব ও মাদ্রাসা স্থাপন
· মুসলমান পরিদর্শক নিয়োগ
ধর্মশিক্ষা
· সরকারি স্কুল ও কলেজে ধর্মশিক্ষা নিষিদ্ধ রাখা
· ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখা
· ধর্মীয় শিক্ষা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক
· নীতিশিক্ষামূলক পুস্তক প্রণয়ন
· মানবিক কর্তব্য ও নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কে বক্তৃতার ব্যবস্থা
নারীশিক্ষা
· বেসরকারি বালিকা বিদ্যালয়গুলিকে উদারভাবে সাহায্য
· বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য নিয়মকানুন শিথিলকরণ
· বেতন সম্পর্কে বিশেষ সুবিধা
· মহিলা পরিদর্শক নিয়োগ
· মেয়েদের জন্য সহজতর ও ব্যবহারিক পাঠ্যক্রম
· ভিন্ন ধরনের পাঠ্যপুস্তক রচনা
ঐতিহাসিক মূল্যায়ন
হান্টার কমিশনের মাধ্যমিক শিক্ষা সংক্রান্ত সুপারিশগুলি ছিল অত্যন্ত দূরদর্শী। তারা ১৩৪ বছর আগেই: ব্যবহারিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন
· দ্বি-শাখা পাঠ্যক্রমের ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন
হান্টার কমিশনের ফলাফল:
প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার: হান্টার কমিশনের পর প্রাথমিক শিক্ষা স্বতন্ত্র গুরুত্ব পায় এবং স্থানীয় সংস্থা পরিচালনায় বিদ্যালয় স্থাপন বৃদ্ধি পায়।
বেসরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি: অনুদান নীতির ফলে বেসরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৮৮১–১৮৮২ সালে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল ৩,৯৬১টি, যা ১৮৯১–১৮৯২ সালে বেড়ে হয় ৫,১২৪টি।
দ্বৈত কোর্স (A ও B): “B কোর্স” চালু হওয়ার ফলে ব্যবহারিক শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়, যদিও পরে তা কম জনপ্রিয় হয়।
হান্টার কমিশনের সমালোচনা (Criticism of Hunter Commission)
১. মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে অস্পষ্টতা
· গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নীরবতা: কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট সুপারিশ প্রদান করেনি
· ইংরেজির প্রতি পক্ষপাত: ধারণা করা হয় কমিশন ইংরেজি ভাষাকেই মাধ্যম হিসেবে বহাল রাখতে চেয়েছিল
· মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা: স্থানীয় ভাষাগুলিকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণের বিষয়ে কোনো উৎসাহ প্রদান করা হয়নি
২. বি-কোর্সের (B-Course) ব্যর্থতা
· অবাস্তবিক ধারণা: কমিশন ভেবেছিল ছাত্ররা বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে বেশি পছন্দ করবে, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি
· সামাজিক মানসিকতা বুঝতে ব্যর্থ: ভারতীয় সমাজে বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে নিম্নস্তরের হিসেবে দেখা হতো
· পর্যাপ্ত পরিকল্পনার অভাব: বি-কোর্স সফল করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও মানসিকতা গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হয়নি
৩. আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি
· অসামঞ্জস্যপূর্ণ বেতন নীতি: বেসরকারি কলেজগুলিকে সরকারি কলেজের চেয়ে কম বেতন ধার্যের অনুমতি দেওয়া
· অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা: এটি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে
· মানের অবনতি: কম বেতনের ফলে বেসরকারি কলেজগুলিতে শিক্ষার মান নেমে যাওয়ার আশঙ্কা
৪. ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা নীতির সীমাবদ্ধতা
· বাস্তবসম্মত নয়: ভারতীয় সমাজে ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্বকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা
· মিশনারী চাপের কাছে নতি: খ্রিস্টান মিশনারীদের চাপে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ
· সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট উপেক্ষা: ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে বিবেচনায় না নেওয়া
৫. সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সূত্রপাত
· মুসলিমদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা: মুসলমানদের জন্য পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থার সুপারিশ
· সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন: এটি পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে আরও গভীর করে
· সমজাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার অভাব: জাতীয় একত্রীকরণের পরিবর্তে বিভাজনকে উৎসাহিত করা
৬. নারী শিক্ষায় অপর্যাপ্ত গুরুত্ব
· রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি: নারী শিক্ষাকে পুরোপুরি উৎসাহিত না করা
· পৃথক পাঠ্যক্রম: মেয়েদের জন্য "সহজতর" পাঠ্যক্রমের সুপারিশ করে লিঙ্গবৈষম্যকে প্রশ্রয় দেওয়া
· মহিলা শিক্ষিকার অভাব: পর্যাপ্ত সংখ্যক মহিলা শিক্ষিকা ও পরিদর্শিকা নিয়োগের ব্যবস্থা না করা
৭. প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি অবহেলা
· মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার প্রতি পক্ষপাত: প্রাথমিক শিক্ষাকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব না দেওয়া
· আর্থিক বরাদ্দের অভাব: প্রাথমিক শিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দের ব্যবস্থা না করা
· স্থানীয় সংস্থার উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতা: প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় সংস্থার উপর ছেড়ে দেওয়া
৮. কারিগরি শিক্ষার সীমিত দৃষ্টিভঙ্গি
· যন্ত্রশিক্ষা উপেক্ষা: যান্ত্রিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করা
· অর্ধ-সিদ্ধান্ত: শুধুমাত্র বি-কোর্স চালু করে কারিগরি শিক্ষার সম্পূর্ণ বিকাশ না করা
· শিল্পায়নের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে ব্যর্থ: ভারতের শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি শিক্ষার ভিত্তি স্থাপনে ব্যর্থ
৯. উচ্চশিক্ষার প্রতি অতিমাত্রায় গুরুত্ব
· কলেজ শিক্ষার সম্প্রসারণ: উচ্চশিক্ষার প্রতি অতিমাত্রায় গুরুত্বারোপ
· মাধ্যমিক শিক্ষার সাথে সংযোগের অভাব: মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার মধ্যে কার্যকর সংযোগ স্থাপনে ব্যর্থ
· গবেষণার অভাব: বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে গবেষণা ও উন্নয়নের উপর insufficient গুরুত্ব
১০. বাস্তবায়ন সংক্রান্ত সমস্যা
· অবাস্তবিক সুপারিশ: অনেক সুপারিশ বাস্তবায়নের অযোগ্য ছিল
· আর্থিক সীমাবদ্ধতা: সুপারিশগুলি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা না করা
· প্রশাসনিক জটিলতা: কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব
১১. জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার অভাব
· ঔপনিবেশিক মানসিকতা: ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষার দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে
· জাতীয় একত্রীকরণের অভাব: ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনা বিকাশের পরিবর্তে বিভাজনকেই উৎসাহিত করা
· সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অবহেলা: ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি উপযুক্ত গুরুত্ব না দেওয়া
১২. শিক্ষক প্রশিক্ষণের অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা
· গুণগত মানের অভাব: শিক্ষক প্রশিক্ষণের গুণগত মান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ
· পর্যাপ্ত প্রতিষ্ঠানের অভাব: প্রয়োজনীয় সংখ্যক নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা না করা
· প্রশিক্ষণের মান নিয়ন্ত্রণের অভাব: শিক্ষক প্রশিক্ষণের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থার অভাব
মূল্যায়ন:
১. হান্টার কমিশন ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় এনে দেয়।
২. প্রথমবার প্রাথমিক শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
৩. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের হাতে শিক্ষার দায়িত্ব প্রদান ছিল গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ।
৪. তবে, মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে জোর না দেওয়ায় এটি একটি বড় ত্রুটি।
৫. ব্যবহারিক শিক্ষার গুরুত্ব স্বীকার করলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি।
সারসংক্ষেপ: “হান্টার কমিশন” ছিল ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার এক বাস্তবধর্মী সংস্কার উদ্যোগ। এটি শিক্ষাকে গণমুখী ও জীবনমুখী করার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তবে এর সীমাবদ্ধতা ছিল ইংরেজি মাধ্যমের আধিপত্য ও ব্যবহারিক শিক্ষার অনুপস্থিতি।
Comments
Post a Comment