Hartog Committee 1929
হার্টগ কমিটি রিপোর্ট(Hartog Committee Report, 1929)
ভূমিকা (Introduction)
১৯১৯ সালের ভারতশাসন সংস্কার আইন (Government of India Act, 1919) অনুযায়ী নির্ধারিত হয় যে, দশ বছর পর একটি কমিশন বসে এই সংস্কারের সাফল্য-ব্যর্থতা পর্যালোচনা করবে।ফলে ১৯২৭ সালে স্যার জন সাইমনের সভাপতিত্বে “Simon Commission” গঠন করা হয়। কিন্তু তাতে কোনো ভারতীয় সদস্য না থাকায় সারাদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়।এই Simon Commission ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কেও অনুসন্ধান করতে চেয়েছিল।তাই ১৯২৮ সালে তারা স্যার ফিলিপ হার্টগ (Sir Philip Hartog)-এর নেতৃত্বে একটি উপকমিটি (Sub-Committee) নিয়োগ করে।
এই উপকমিটি ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাদের রিপোর্ট জমা দেয়, যা ইতিহাসে পরিচিত “Hartog Committee Report, 1929” নামে।
কমিটির উদ্দেশ্য (Objectives)
1. ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান ও কার্যকারিতা পরীক্ষা করা।
2. শিক্ষা বিস্তারের বদলে গুণগত উন্নতির উপর জোর দেওয়া।
3. প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার দুর্বল দিকগুলো শনাক্ত করে সংস্কারের পরামর্শ দেওয়া।
4. “Wastage” ও “Stagnation” সমস্যা বিশ্লেষণ করা।
হার্টগ কমিটির মূল সুপারিশসমূহ (Main Recommendations of Hartog Committee)
১. প্রাথমিক শিক্ষা (Primary Education)
ত্রুটি বা সমস্যা বিশ্লেষণ
প্রাথমিক শিক্ষায় অতিরিক্ত অপচয় (Wastage) ও অনুন্নয়ন (Stagnation) বিদ্যমান।
গ্রামাঞ্চলে বিদ্যালয়ের অভাব, দারিদ্র্য, সামাজিক কুসংস্কার, ও যাতায়াতের অসুবিধা শিক্ষার পথে বড় বাধা।
মেয়েদের বিদ্যালয় ও শিক্ষিকার সংখ্যা খুবই কম।
পাঠ্যসূচি জীবনের বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন।
বিদ্যালয় পরিদর্শন ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের ঘাটতি প্রকট।
অপচয় (Wastage)
যে ছাত্ররা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করে, তারা শিক্ষাব্যবস্থার “অপচয়” হিসেবে গণ্য।
গ্রামে বহু ছাত্র চার বছরের শিক্ষাজীবন সম্পূর্ণ করতে পারে না।
অনুন্নয়ন (Stagnation)
যে ছাত্ররা ফেল করে একই শ্রেণিতে বছরের পর বছর থেকে যায়, সেটি অনুন্নয়ন নামে পরিচিত।
সুপারিশসমূহ
1. “Expansion” নয়, বরং “Consolidation Policy” বা দৃঢ়ীকরণ নীতি গ্রহণ করতে হবে।
2. অপ্রয়োজনীয় স্কুল বন্ধ করে প্রয়োজনীয় অঞ্চলে মানসম্পন্ন বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।
3. প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ হবে কমপক্ষে ৪ বছর।
4. পাঠ্যসূচি নমনীয় ও জীবনভিত্তিক হতে হবে; স্বাস্থ্যশিক্ষা ও চরিত্রগঠনের ওপর জোর দিতে হবে।
5. বিদ্যালয় পরিদর্শক সংখ্যা বৃদ্ধি ও নিয়মিত পরিদর্শন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
6. যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও পর্যাপ্ত বেতন ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
7. শিক্ষকদের জন্য Refresher Course চালু করতে হবে।
8. প্রাথমিক শিক্ষাকে ধীরে ধীরে আবশ্যিক ও সর্বজনীন করার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
9. গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলিকে পল্লি উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
10. স্থানীয় প্রয়োজন অনুযায়ী বিদ্যালয়ের সময়সূচি ও ছুটি নির্ধারণ করতে হবে।
২. মাধ্যমিক শিক্ষা (Secondary Education)
ত্রুটি
1. প্রবেশিকা পরীক্ষায় বিপুল সংখ্যক ছাত্র ফেল করছে — শিক্ষার মান কমছে।
2. নিম্ন শ্রেণিতে অযথা প্রোমোশন দেওয়া হচ্ছে, ফলে অযোগ্য ছাত্র উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করছে।
3. মাধ্যমিক স্তরে বৃত্তিমূলক শিক্ষার অভাব।
সুপারিশসমূহ
1. নিম্ন শ্রেণিতে প্রোমোশন নীতিতে কড়াকড়ি করতে হবে।
2. মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রমকে বহুমুখী (Diversified) করতে হবে।
3. ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের প্রবণতা অনুযায়ী বাণিজ্য, কারিগরি বা শিল্প শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
4. মাধ্যমিক স্তরে বহু বিকল্প শাখা (Multiple Streams) চালু করতে হবে।
৩. উচ্চশিক্ষা (Higher Education)
সমস্যা
1. ভারতের মতো বিশাল দেশে এককেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয় কার্যকর নয়।
2. মাধ্যমিক স্তরে অযথা প্রোমোশন দেওয়ায় অযোগ্য ছাত্র কলেজে ভর্তি হচ্ছে।
3. ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ক্রমশ নিম্নগামী।
সুপারিশসমূহ
1. কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কঠোরতা আরোপ করতে হবে।
2. নির্বাচিত কলেজে অনার্স কোর্স চালু রাখতে হবে।
3. গ্রন্থাগার ও গবেষণার পরিকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে।
4. টিউটোরিয়াল ক্লাস (Tutorial System) চালু করতে হবে।
5. বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণা ও উচ্চমানসম্পন্ন শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
৪. স্ত্রীশিক্ষা (Women’s Education)
ত্রুটি
ছেলে ও মেয়ের শিক্ষায় চরম বৈষম্য।
গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের জন্য স্কুল ও শিক্ষিকার অভাব।
সুপারিশ
1. মেয়েদের জন্য বিশেষ পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করতে হবে।
2. যোগ্য মহিলা শিক্ষক ও পরিদর্শিকা নিয়োগ করতে হবে।
3. স্ত্রীশিক্ষাকে আবশ্যিক (Compulsory) করতে হবে।
4. প্রতিটি প্রদেশে স্ত্রীশিক্ষার উন্নয়নের জন্য একজন ডেপুটি ডিরেক্টর নিয়োগ করতে হবে।
মূল্যায়ন (Evaluation)
1. হার্টগ কমিটির সুপারিশগুলো গুণগত শিক্ষার উন্নতির দিকে মনোনিবেশ করেছিল, সংখ্যা বৃদ্ধির দিকে নয়।
2. “Wastage” ও “Stagnation”—এই দুটি ধারণা ভারতের শিক্ষা-ইতিহাসে প্রথম একাডেমিকভাবে ব্যবহৃত হয়।
3. শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পাঠ্যক্রম সংস্কার ও প্রশাসনিক তদারকির ওপর জোর দেওয়া হয়।
4. এর ফলে বহু নিম্নমানের বিদ্যালয় বন্ধ হয়; ফলে গুণগত উন্নয়ন ঘটলেও পরিমাণগত উন্নতি ব্যাহত হয়।
5. স্ত্রীশিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়।
6. তবে, শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি, পর্যবেক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধি, ও বয়স্ক শিক্ষার বিষয়গুলোতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
উপসংহার (Conclusion)
হার্টগ কমিটির রিপোর্ট ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে গুণগত দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়নের প্রথম প্রয়াস।এটি শিক্ষা সম্প্রসারণ নয়, বরং “শিক্ষার মান উন্নয়ন”-এর ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে।যদিও এর অনেক প্রস্তাব তৎকালীন আর্থিক ও প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার কারণে বাস্তবায়িত হয়নি,তবুও এই রিপোর্ট ভারতের আধুনিক শিক্ষার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত।
মূল মন্ত্র: “Education should not merely be expanded, it must be improved.”
— Hartog Committee, 1929
Comments
Post a Comment