Discuss about Woods Dispatch 1854
উডের ডেসপ্যাচ (১৮৫৪)
ভূমিকা :
১৮১৩ সালের সনদ আইন, ১৮৩৫ সালের মেকলে মিনিট, এবং ১৮৩৭ সালের ইংরেজি শিক্ষা আইন — এই ধারাবাহিকতায় ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা ইংরেজি আধুনিকতার দিকে এগোতে থাকে।কিন্তু এই শিক্ষা ছিল অগোছালো, একক কোনো নীতি ছিল না।সেই জন্য ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, ভারতের জন্য একটি একক ও কেন্দ্রীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করতে হবে।
১৮৫৪ সালে চার্লস উড (Charles Wood), যিনি তখন “President of the Board of Control”, তিনি ভারতের শিক্ষানীতি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে একটি দলিল তৈরি করেন —
এটাই Wood’s Despatch নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। এটি প্রকাশিত হয় ১৯ জুলাই, ১৮৫৪ সালে।
এই দলিলটি ছিল ভারতের শিক্ষানীতির এক নতুন যুগের সূচনা, তাই একে বলা হয় —“The Magna Carta of English Education in India.”
ঐতিহাসিক পটভূমি:
১৮১৩ সালের সনদ আইনের পর থেকে ভারতবর্ষের শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার মাধ্যম, উদ্দেশ্য ও নীতি নিয়ে নানা সমস্যা, মতবাদ ও পরস্পরবিরোধী নীতি গড়ে উঠছিল। প্রায় ৪০ বছর পরে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের সমস্যা ও ব্যাপকগতিতে বিস্তার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ১৮৫৩ সালে কোম্পানির সনদ নতুন করে নেওয়ার সময় আসে। তখন বিভিন্ন প্রদেশের শিক্ষানীতির পরিবর্তে এক কেন্দ্রীভূত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সে জন্য ১৮৫৪ সালে সনদ নবীকরণ করার আগে কোম্পানি ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার আনুপূর্বিক তথ্যানুসন্ধানের নির্দেশ দেন। উডের ডেসপ্যাচ ১৮৫৪ সালে ইংল্যান্ডের বোর্ড অফ কন্ট্রোল-এর সভাপতি স্যার চার্লস উড-এর নামে এই শিক্ষানীতি সংক্রান্ত দলিল রচিত হয়। ভারতবর্ষেই তা 'উডের ডেসপ্যাচ' (Wood's Despatch) নামে পরিচিত হয়।
শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য: এই দলিলে শিক্ষার উদ্দেশ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলি সোচ্চার করা হয়েছিল:
১. ভারতের শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে প্রয়োজনীয় পাশ্চাত্য জ্ঞান উদ্ঘাটিত করা।
২. এই পাশ্চাত্য জ্ঞান হবে ভারতবাসীর পক্ষে বৈজ্ঞানিক ও জাগতিক বিষয়বস্তুর স্বরূপ।
৩. এ শিক্ষায় ভারতবাসীর বুদ্ধি ও চরিত্রের উন্নতি হবে।
৪. এ শিক্ষা বিশ্বস্ত ও যোগ্য সরকারি কর্মচারী তৈরি করবে।
৫. ইংল্যান্ডের শিল্প-বাণিজ্যের কাঁচামালের সরবরাহ অব্যাহত রাখা এবং ভারতের বাজারে ইংল্যান্ডের উৎপন্ন পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করা ছিল সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক লক্ষ্য।
৬. পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে ভারতবাসীর আমদানি ও পুঁজি বিনিয়োগের ব্যাপারটা বুঝবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার অনুধাবন করতে সক্ষম হবে।
প্রধান সুপারিশসমূহ:
১. শিক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা প্রত্যেক প্রদেশে একজন শিক্ষা অধিকর্তা (Director of Public Instruction) নিয়োগ করা হবে। তাঁর অধীনে প্রতিটি জেলায় কয়েকজন ডেপুটি ইনস্পেক্টর (Deputy Inspector) নিযুক্ত হবেন যারা বিদ্যালয় পরিদর্শন করে নির্দেশ ও পরামর্শ দিবেন এবং সরকারের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দিবেন।
২. বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা উডের ডেসপ্যাচে ভারতীয়গণের জন্য সর্বাধিক সাফল্যমণ্ডিত ও উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। উড সাহেব কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বাই - এই তিনটি শহরে মোট তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরামর্শ দেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলি পরিচালনার দায়িত্ব একজন চ্যান্সেলরের অধীনে ভাইস-চ্যান্সেলর ও কতিপয় সরকার-মনোনীত সদস্যের দ্বারা গঠিত সিনেটের উপর অর্পিত থাকবে।
৩. প্রাথমিক শিক্ষা উডের ডেসপ্যাচের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার। সে কালের অনুদয়-ভিত্তিক নীতি বাতিল করে সর্বত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনে সরকারকে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে মাতৃভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।
৪. অনুদান ব্যবস্থা উড সাহেব শিক্ষার গতি দ্রুত করার জন্য অনুদান ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলেন। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিকে শিক্ষা বিভাগের মাধ্যমে সরকারি অনুদান দেওয়ার কথা বলা হয়। তবে যে সকল বেসরকারি বিদ্যালয় সরকারি অনুদান পাবে, তাদের বিদ্যালয় পরিচালনা, ছাত্র সংখ্যা, শিক্ষাদানের উপকরণ ইত্যাদি বিষয়ে সরকারি তত্ত্বাবধান করতে হবে।
৫. শিক্ষক শিক্ষণ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের জন্য পৃথক শিক্ষক শিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সুপারিশ করা হয়। যোগ্য শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। শিক্ষকতা পেশাকে অন্যান্য চাকুরির মতো আকর্ষণীয় করে তোলার পরামর্শ দেওয়া হয়।
৬. নারী শিক্ষা নারী শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার সম্পর্কে ডেসপ্যাচে সতর্ক দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। বালিকাদের শিক্ষার জন্য পৃথক বিদ্যালয়ের সুপারিশ করা হয়। অনুদান-সাহায্যের মাধ্যমে নারী শিক্ষা বিস্তার করতে হবে।
৭. বৃত্তিমূলক শিক্ষা বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য পৃথক ব্যবস্থা করার সুপারিশ করা হয়। আইন, চিকিৎসা, কারিগরিবিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা বলা হয়।
৮. ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ধর্ম শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে ডেসপ্যাচে বলা হয়েছে যে, ভারতের মতো বহু ধর্ম-বিশ্বাসের দেশে কোনো বিশেষ ধর্ম শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই সরকারি সাহায্য দান নীতিতেও ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা অগ্রাহ্য করে লোকশিক্ষার উন্নতি বিধানের উপর স্থাপিত করা হয়েছে।
Comments
Post a Comment