Discuss about Macaulay’s Minute 1835

 লর্ড মেকলের মিনিট (১৮৩৫)

ভূমিকা :

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে সনদ আইনের মাধ্যমে ভারতে শিক্ষাবিস্তারের জন্য সরকারকে বছরে এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। এই অর্থ কিভাবে ব্যয় করা হবে, অর্থাৎ “ভারতীয় ভাষা নাকি ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হবে” — এই বিষয়ে প্রবল মতভেদ দেখা দেয়। এই বিতর্কের সমাধানের জন্য তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি লর্ড থমাস ব্যাবিংটন মেকলে (Lord Macaulay)-কে এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিতে অনুরোধ করেন।

এর ফলেই ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় ঐতিহাসিক “Macaulay’s Minute on Education” — যা ভারতের আধুনিক শিক্ষার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়।


ঐতিহাসিক পটভূমি:

১৮২৩ সালে জনশিক্ষা সমিতি (General Committee of Public Instruction - GCPI) নামে ভারতীয় শিক্ষা কার্যের জন্য একটি শিক্ষা সংস্থা গঠিত হয়েছিল। ১৮১৩ সালের সনদ আইনের বরাদ্দকৃত এক লক্ষ টাকা কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তার দায়িত্ব এই কমিটির উপর দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই তহবিলের সমবন্টনের ক্ষেত্রে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য পক্ষের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এই বিরোধের নিষ্পত্তির জন্য ১৮৩৪ সালের ১০ই জুন লর্ড মেকলে ভারতে গভর্নর জেনারেলের নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে আসেন। গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক লর্ড মেকলের উপর এই বিরোধ (প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বিতর্ক) নিষ্পত্তির ভার দেন এবং ১৮১৩ সালের সনদ আইনের ৪৩ নং ধারার অস্পষ্টতা দূর করে এই বিরোধের মীমাংসা করতে অনুরোধ করলেন।


মেকলে মিনিট (২রা ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৫):

তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্কের অনুরোধে লর্ড মেকলে ১৮৩৫ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি যে দিগদর্শন বিবরণী (Minute) প্রকাশ করলেন, তা ভারতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক দলিল বলে পরিগণিত হয়ে আসে। মেকলে সাহেবের প্রস্তাবে ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল।


লর্ড মেকলের বিবরণীর প্রধান বক্তব্য:

1.ইংরেজি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করা হবে। তিনি বলেন, “We must teach the natives of India English education through English language.”

2. সংস্কৃত ও আরবি ভাষায় শিক্ষা অপ্রয়োজনীয়। তিনি মনে করতেন, এ ভাষাগুলিতে আধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের জ্ঞান নেই।

3. ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হবে।

যেমন: নিউটন, মিল্টন, বেকন প্রমুখ ইউরোপীয় মনীষীদের রচনাসমূহ পড়ানো হবে।

4. দেশীয় বিদ্যালয়গুলির সংস্কার এবং পুরনো বিদ্যালয়গুলি বন্ধ করা। মেকলে মনে করতেন, পুরনো মাদ্রাসা ও সংস্কৃত টোলগুলি অকেজো।

5. ‘Downward Filtration Theory’  তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রথমে অল্পসংখ্যক উচ্চশিক্ষিত শ্রেণি গড়ে তুলতে হবে, যারা পরবর্তীতে সাধারণ জনগণের মধ্যে শিক্ষা ছড়িয়ে দেবে।


মেকলের মূল যুক্তিসমূহ:

১৮১৩ সালের সনদ আইন সম্পর্কে মেকলের ব্যাখ্যা: মেকলে ১৮১৩ সালের সনদ আইনের "সাহিত্যের উন্নতি" সম্পর্কে যুক্তি দেখালেন যে, "সাহিত্যের উন্নয়ন" বলতে শুধুমাত্র সংস্কৃত ও আরবি সাহিত্যকে বোঝায় না, এর দ্বারা উৎকৃষ্ট সাহিত্যকেও বোঝানো হয়েছে।

শিক্ষার বিষয়বস্তু সম্পর্কে:

প্রাচীন ভারতীয়দের বেদ এবং নিউটনের আবিষ্কার বা মিল্টনের কাব্য - উভয়তেই শিক্ষিত ভারতীয়গণ একইভাবে অভিভূত হবেন।

অর্থ বরাদ্দ সম্পর্কে:  সংস্কৃত ও আরবি সাহিত্যের উন্নতির জন্য এই অর্থ খরচ করা হবে না, বরং পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ও অর্জনের জন্যও এই অর্থ খরচ করা হবে।

মেকলে মিনিটের সমালোচনা:

ইংরেজি শিক্ষার পথে এই দলিলটি তৈরি করে মেকলে সমভাবে নিন্দিত ও প্রশংসিত হয়েছেন:

ইতিবাচক দিক:

১. মেকলে দেশে আসার অনেক আগে থেকেই এ দেশের জনসাধারণ ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। কালের অনিবার্য গতিতে এটি হতো, মেকলের মিনিটে তা শুধুমাত্র ত্বরান্বিত হয়েছিল।

২. আধুনিক শিক্ষার বিকাশে মেকলের মিনিট গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলেই আধুনিক শিক্ষাবিস্তারের সরকারি নীতি ঘোষিত হয়। ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে রাজা রামমোহন রায়ের প্রচেষ্টা এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য প্রমাণ।

৩. মেকলে দেশীয় ভাষাগুলিকে দুর্বল ও অনুপযুক্ত বললেও, মাতৃভাষাকে নিজের আসনে প্রতিষ্ঠিত করার কথা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এজন্য সংস্কৃত ও আরবি ভাষার শিক্ষার ব্যাপারেও তাঁর মিনিটে স্থান পেয়েছে।


নেতিবাচক দিক:

১. মেকলের সবচেয়ে নিন্দনীয় কাজ হচ্ছে ভারতীয় সাহিত্য, পুরাণ ও ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞতাপ্রসূত অর্ধসত্য মন্তব্য। তবে একথা দিয়েই তাঁকে সবদিক দিয়ে বিচার করা চলে না।

২. ভারতীয় প্রাচীন ঐতিহ্য সম্পর্কে তিনি অসম্পূর্ণ বর্ণনা দিয়ে পাশ্চাত্য জ্ঞানকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করতে গেছেন - এটাই তাঁর প্রধান ত্রুটি।


উপসংহার:

লর্ড মেকলের মিনিট ভারতের শিক্ষা ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ইংরেজি ভাষার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে এবং আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করে। যদিও এর কিছু সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা রয়েছে, তবুও এটি ভারতের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

এ কারণেই ইতিহাসবিদরা বলেন —  “The Macaulay’s Minute of 1835 was the foundation stone of modern education in India.”

Comments

Popular posts from this blog

National Education Policy (2020)

Charter Act of 1813 and Its Educational Implication.

National Policy on Education (1968)