Curzon Educational Policy & National Educational Movement 1905

Curzon Educational Policy 

লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতি, যা মূলত ১৯০৪ সালের ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন দ্বারা মূর্ত হয়েছিল, ভারতীয় শিক্ষার সংস্কার ও আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে ছিল কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছিল। এই নীতির ফলে ১৯০২ সালে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরীক্ষা করার জন্য র‍্যালি কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়, যার ফলে এই আইনটি সরকারি নিয়ন্ত্রণ কঠোর করে, গবেষণা সুবিধা উন্নত করে এবং উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারিত করে। তবে, স্বায়ত্তশাসন দমন এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনের প্রচেষ্টার জন্য জাতীয়তাবাদীরা এর সমালোচনা করেছিল।


কার্জনের শিক্ষাসংস্কারের পটভূমি

বিংশ শতকের গোড়ায় লর্ড কার্জন ভারতবর্ষে ভাইসরয় হয়ে আসেন। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক কিন্তু গোঁড়া সাম্রাজ্যবাদী। তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল:

· ভারতবাসীর মনে জাগ্রত জাতীয়তাবোধকে দমন করা
· ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় করা
· শিক্ষার মাধ্যমে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করা

শিক্ষা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা

ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় নানা সমস্যা দেখা দিয়েছিল:

১. হান্টার কমিশনের ব্যর্থতা: 'এ' ও 'বি' কোর্স প্রবর্তন সার্থক হয়নি

২. ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি: কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ছাত্রসংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল

৩. শিক্ষার মান হ্রাস: প্রতিষ্ঠান ও ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার মান যথেষ্ট নেমে গিয়েছিল

৪. শিক্ষিত বেকার সমস্যা: বিশ্ববিদ্যালয়ে পাসের হার চাকরির সংখ্যাকে অতিক্রম করেছিল

সিমলা শিক্ষাসম্মেলন, ১৯০১

কার্জন ১৯০১ সালে সিমলায় একটি শিক্ষাসম্মেলন আহ্বান করেন যেখানে:

· কোনো ভারতীয়কে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি
· শুধুমাত্র বিভিন্ন প্রদেশের DPI-দের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল
· কার্জন নিজেই খসড়া প্রস্তাব প্রস্তুত করেছিলেন
· ১৫০টি প্রস্তাব গৃহীত হয়

ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠন

গঠন (২৭শে জানুয়ারি, ১৯০২):

· প্রথমদিকে কোনো ভারতীয় সদস্য রাখা হয়নি
· পরে স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৈয়দ হাসান বিলগ্রামীকে ভারতীয় সদস্যরূপে নেওয়া হয়
· স্যার গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় শেষে পৃথক রিপোর্ট পেশ করেছিলেন

দায়িত্ব:

· শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন কলেজগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ
· বিশ্ববিদ্যালয় পুনর্গঠনের সুপারিশ করা
· মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে সুপারিশ করার অধিকার ছিল না

কমিশনের প্রেক্ষাপট ও সমস্যাসমূহ

১. সংস্কারের অভাব: ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ) পঞ্চাশ বছরে কোনো সংস্কার হয়নি

২. প্রশাসনিক চাপ: মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধির ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে প্রচণ্ড চাপ

৩. সদস্য সংখ্যার সমস্যা: সেনেটের সদস্যসংখ্যা নির্দিষ্ট না থাকায় বিরাট সংখ্যায় পরিণত হয়েছিল

৪. শিক্ষার মান হ্রাস: বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শুধুমাত্র পরীক্ষা গ্রহণ এবং কলেজ অনুমোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল

কার্জনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য

কার্জন স্পষ্টভাবে বলেছিলেন:

"আমার বিশ্বাস, ভেঙে পড়ার আগে কংগ্রেস টলমল করছে এবং ভারতবর্ষে থাকাকালে আমার অন্যতম প্রধান আকাঙ্ক্ষাই হল তার শান্তিপূর্ণ মৃত্যুতে সাহায্য করা।"

এই উদ্দেশ্যে তিনি:

· বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল আইন পাস করেন
· ভারতবাসীর রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার মূলে কুঠারাঘাত করতে চেয়েছিলেন
· ১৯০৪ সালে 'ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন' পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করেন

কমিশনের সুপারিশসমূহ (১৯০২)

কমিশন ১৯০২ সালের জুন মাসে তার রিপোর্ট পেশ করে যার প্রধান সুপারিশগুলি ছিল:

প্রশাসনিক সংস্কার

১. সেনেট পুনর্গঠন: সেনেটের সদস্যসংখ্যা সীমিতকরণ
 ২.কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন: ছোটো ও কার্যকরী কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন 
.আজীবন সদস্যপদ বিলোপ: আজীবন সদস্যপদ প্রথার বিলোপ

শিক্ষাগত সংস্কার

১. শিক্ষণ কার্যের প্রসার: বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে শুধুমাত্র পরীক্ষা গ্রহণের পরিবর্তে শিক্ষণ কার্যের দায়িত্ব দেওয়া 
২.স্নাতকোত্তর শিক্ষা: স্নাতকোত্তর শিক্ষা ও গবেষণার ব্যবস্থা করা 
৩.অধিভুক্ত কলেজ নিয়ন্ত্রণ: অধিভুক্ত কলেজগুলির উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা

আর্থিক সংস্কার

১. বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক: সরকারি অনুদান বৃদ্ধি 
২.কলেজগুলির জন্য: কলেজগুলির জন্য পৃথক অনুদান ব্যবস্থা

ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯০৪

কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৯০৪ সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয় যা:

· বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করে
· সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যাবলিতে হস্তক্ষেপের ক্ষমতা দেয়
· ভারতীয়দের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি করে

ঐতিহাসিক মূল্যায়ন

ইতিবাচক দিক:
 ১.বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা 
২.শিক্ষার মানোন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ 
৩.প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠনের প্রস্তাব

নেতিবাচক দিক: 
১.রাজনৈতিক উদ্দেশ্য: শিক্ষাকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার ২.ভারতীয়দের বাদ দেওয়া: প্রথমদিকে কোনো ভারতীয় সদস্য না রাখা 
৩.গণবিরোধী পদক্ষেপ: সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষার স্বাধীনতা হরণ 
৪.সীমিত দায়িত্ব: মাধ্যমিক শিক্ষাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা


লর্ড কার্জনের শিক্ষা সংক্রান্ত সুপারিশসমূহ

প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত সুপারিশ ,কার্জন প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিলেন:

১. রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব: "প্রাথমিক শিক্ষার সক্রিয় সম্প্রসারণ রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য" - এই নীতি গ্রহণ

২. আর্থিক বরাদ্দ:
· প্রাদেশিক সরকারের শিক্ষা বাজেটের বেশিরভাগ অর্থ প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বরাদ্দ
· শিক্ষা খাতের জন্য নির্ধারিত অর্থ শুধুমাত্র প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যয় করা

৩. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন:
· স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠানগুলি নিজ নিজ এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা প্রস্তুত করবে
· পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য শিক্ষা অধিকর্তার (DPI) অনুমোদন প্রয়োজন

৪. পাঠ্যক্রম ও মাধ্যম:

· গ্রামীণ ও শহুরে এলাকার জন্য পৃথক পাঠ্যক্রম
· শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা

৫. শিক্ষক প্রশিক্ষণ:

· শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন
· শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি

৬. মূল্যায়ন পদ্ধতি: পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে অনুদান ব্যবস্থা বাতিল

৭. গণশিক্ষা: প্রাথমিক শিক্ষাকে গণশিক্ষার রূপ দিতে বিভিন্নভাবে আরও প্রাসঙ্গিক করে তোলা


মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কিত সুপারিশ

কার্জন মাধ্যমিক শিক্ষায় দুটি নীতি গ্রহণ করেন: নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন

নিয়ন্ত্রণ:

· সরকার বিভিন্নভাবে বেসরকারি উদ্যোগকে নিয়ন্ত্রণ করবে
· বিদ্যালয় অনুমোদন ও পরিদর্শনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ

উন্নয়ন:

১. আর্থিক সহায়তা: অনুমোদিত সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে পর্যাপ্ত আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা

২. শিক্ষক প্রশিক্ষণ: শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে শিক্ষকদের শিক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকীকরণ

৩. শিক্ষার মাধ্যম: মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা, তবে উন্নতমানের ইংরেজি শিক্ষারও ব্যবস্থা রাখা

৪. পরিদর্শন ব্যবস্থা: বিদ্যালয় পরিদর্শন ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকরী করা

৫. সরকারি বিদ্যালয়: সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বেসরকারি বিদ্যালয়ের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ যুক্তিসংগত পর্যায়ে রাখা


উচ্চশিক্ষা সম্পর্কিত সুপারিশ

কার্জনের উচ্চশিক্ষা নীতি ছিল দ্বিমুখী:

১. সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: উচ্চশিক্ষিত ভারতবাসীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জাতীয় আন্দোলন দমন

২. গুণগত মান উন্নয়ন: বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গুণগত মান উন্নয়ন

পরিণতি:

· উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়রাই পরবর্তীতে জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন
· তাদের সংগ্রামের ফলেই ভারত স্বাধীনতা লাভ করে
· এই আইনের মাধ্যমে ইউরোপীয়দের হাতে শিক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত হয়
· বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালনা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে


অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ

১. কৃষি শিক্ষা কৃষিবিদ্যা শিক্ষা প্রসারের জন্য কৃষি বিভাগ ও প্রাদেশিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন

২. নারী শিক্ষা  স্ত্রী শিক্ষা প্রসারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ

৩. শিল্প ও কারিগরি শিক্ষা
· শিল্পকলা ও চারুকলা শিক্ষায় সংস্কার
· বিদ্যালয়গুলিকে সুপরিচিত করা
· উচ্চতর কারিগরি শিক্ষার জন্য বিদেশে পড়াশোনার ব্যবস্থা
· বৈদেশিক বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা

৪. সাংস্কৃতিক heritage সংরক্ষণ
· প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ স্থাপন
· স্মৃতি সৌধ সংরক্ষণ আইন (১৯০৪) প্রণয়ন
· ঐতিহাসিক স্থান, প্রাচীন শহর ও ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ
· স্মৃতি স্তম্ভ, মূর্তি ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলির সংস্কারের ব্যবস্থা


লর্ড কার্জনের ভারতীয় শিক্ষায় অবদান

১. শিক্ষা প্রশাসনের সংস্কার:
· শিক্ষা অধিকর্তাদের (Director of Public Instruction) পদ সৃষ্টি করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুসংগঠিত রূপ দেওয়ার চেষ্টা
· শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রথমবারের মতো স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা

২. মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন:

· পরিদর্শন ব্যবস্থার উন্নয়ন
· অনুমোদন বিধানের কঠোরতা আরোপ
· শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের উপর জোর

৩. পাঠ্যক্রমের উন্নয়ন:

· বিভিন্ন শিক্ষার পাঠ্যক্রমের উন্নতি বিধান
· মাতৃভাষার বিকাশের উপর গুরুত্বারোপ
· বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব

৪. বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯০৪:

· বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক উন্নয়ন
· বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু পরীক্ষা গ্রহণের কেন্দ্র না রেখে শিক্ষণ কার্যের দায়িত্ব দেওয়া
· ভারতে প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন

৫. উচ্চশিক্ষার প্রসার:

· বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে উচ্চ শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা
· উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়দের সংখ্যা বৃদ্ধি
· এই শিক্ষিতরা পরবর্তীতে জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন

৬. বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা:

· কৃষি শিক্ষার প্রসার
· চিকিৎসা শিক্ষার উন্নয়ন
· বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার
· কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন
· বাণিজ্য শাস্ত্র শিক্ষার প্রসার

৭. প্রাথমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ:

· প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণের নীতি গ্রহণ
· সাধারণ মানুষের শিক্ষার প্রসারের উপর গুরুত্ব

৮. স্মৃতি সৌধ সংরক্ষণ:

· জাতীয় স্মৃতি সৌধ রক্ষায় আইন প্রণয়ন
· ভারতীয়দের মধ্যে ঐতিহ্য সচেতনতা তৈরি
· প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ

৯. জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের জন্ম:

· কার্জনের শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে ভারতীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া
· জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের সূত্রপাত
· স্বদেশী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রেরণা

১০. স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান:

· উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়রা জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন
· তাদের সংগ্রামের ফলেই ভারত স্বাধীনতা লাভ করে
· কার্জনের নীতিই শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে শক্তিশালী করে


উপসংহার

১৯০২ সালের ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ছিল কার্জনের শিক্ষানীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যদিও এর কিছু ইতিবাচক দিক ছিল, তবুও এর মূলে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্য। এই কমিশন এবং এর ফলে প্রণীত ১৯০৪ সালের আইন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করে এবং ভারতীয় জাতীয়বাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে, যা পরবর্তীতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।





National Educational  Movement 1905 

১. জাতীয় শিক্ষা: সংজ্ঞা ও লক্ষ্য

জাতীয় শিক্ষা হল , এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা যা যুগযুগান্তর জাতির জীবনধারা ও সংস্কৃতিকে বজায় রাখে এবং জাতির মননশক্তি, চরিত্র ও কর্মক্ষমতা বিকাশে সাহায্য করে।

Mrs. Annie Besant:
 “National Education must live in an atmosphere of proud and glorious patriotism…by the study of Indian literature, history, science, art, politics, commerce।”

লক্ষ্য: সকলের সমান অধিকার, মাতৃভাষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ রক্ষা ও দেশের জীবনরস পুষ্টি।

২. আন্দোলনের পটভূমি

ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি: ভারতীয় জীবনধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য উপেক্ষা।

সমস্যা:

1. ইংরেজ সরকার চাইছিল একদল কেরানি তৈরি; ভারতীয় নেতারা চেয়েছিলেন চিন্তাশীল, কার্যক্ষম মানুষ তৈরি।

2. গণশিক্ষা উপেক্ষা → উচ্চশিক্ষার ব্যয় → জনগণ শিক্ষাগতভাবে পিছিয়ে পড়ল।

3. পুথিগত শিক্ষার ওপর জোর, জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত শিক্ষার অভাব।

4. লর্ড কার্জনের শিক্ষানীতি ও বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ।

5. পুনরুজ্জীবনবাদ (Revivalism) → প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ।


৩. জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন: প্রথম পর্যায় (1901–1905)

প্রধান উদ্যোগ:

1901: রবীন্দ্রনাথ বোলপুরে ব্রহ্মচর্যাশ্রম (আবাসিক বিদ্যালয়)।

1902: সেকেন্দ্রাবাদেবৃন্দাবন গুরুকুল।

1903: স্বামী দয়ানন্দের তপোবন স্কুল।

সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি শিক্ষানীতির সমালোচনা।


ডন সোসাইটি (Dawn Society):

প্রতিষ্ঠাতা: সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

উদ্দেশ্য: জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা, দেশসেবা, চরিত্র ও মানসিক উন্নয়ন।


জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (National Council of Education):

1905: রংপুরে প্রথম জাতীয় বিদ্যালয়।

পাঠ্যক্রম: মাতৃভাষা প্রধান, ইংরেজি দ্বিতীয় ভাষা; বিজ্ঞান, কলা, সংস্কৃতি, চরিত্রগঠন।


দুর্বলতা:

1. রাজনীতি ও ভাবাবেগ নির্ভর।


2. নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতবিরোধ।


3. অর্থাভাব ও শিক্ষক-সংকট।


4. মুসলিমদের অংশগ্রহণ সীমিত।


৪. দ্বিতীয় পর্যায় (1906–1922)

প্রেক্ষাপট:

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের পর অহিংস অসহযোগ আন্দোলন।


মূল কার্যক্রম:

জাতীয় বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।

উদাহরণ: জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া (দিল্লি), গুজরাট বিদ্যাপীঠ, কাশী বিদ্যাপীঠ, মহারাষ্ট্র বিদ্যাপীঠ।

শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম → বিশ্বভারতী।

পাঠ্যসূচি: জাতীয় সাহিত্য, ইতিহাস, মাতৃভাষা, কারিগরি ও বৃত্তিশিক্ষা।


মূল্যায়ন:

1921–22: 1,227 জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, 78,581 ছাত্র।

পরিকল্পিত, যুক্তিযুক্ত, সর্বভারতীয়।

মুসলিমদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য।

বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা।

মেয়েদের জন্য পৃথক পাঠ্যসূচি।


৫. তৃতীয় পর্যায় (1935–1937)

প্রেক্ষাপট: ভারত শাসন আইন 1935, কংগ্রেসের প্রদেশ মন্ত্রিসভা।

গান্ধিজির বুনিয়াদি শিক্ষা (Basic Education):

৭ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা, বিনা বেতনে ও আবশ্যিক।

মাতৃভাষা মাধ্যম, ইংরেজি দ্বিতীয় ভাষা।

উৎপাদনধর্মী হাতের কাজ কেন্দ্র করে শিক্ষা।


লক্ষ্য:

1. শিক্ষা ও জীবনের সংযোগ।

2. শ্রমের মর্যাদা ও উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য।

3. সমাজমুখী ও আত্মনির্ভর শিক্ষার্থী।


পাঠ্যক্রমের মূল বিষয়:

কেন্দ্র শিল্প: সুতা-কাটা, কাপড় বোনা, কাঠের কাজ, কৃষি, ফল ও সবজি চাষ, চামড়ার কাজ।

ভাষা: মাতৃভাষা + হিন্দুস্থানী ভাষা।

গণিত: দৈনন্দিন হিসাব-নিকাশ, সাধারণ জ্যামিতি।

সাধারণ বিজ্ঞান: প্রকৃতি, উদ্ভিদ-বিজ্ঞান, প্রাণীবিজ্ঞান, দেহচর্চা, স্বাস্থ্য।

সমাজনীতি: দেশপ্রেম, নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব, ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা।

শিল্প ও সংগীত: চিত্রাঙ্কন, গান।

জ্যোতির্বিদ্যা ও রসায়ন: প্রাথমিক জ্ঞান।

বুনিয়াদি শিক্ষার গুণাবলি

১. কার্যকর শিক্ষা: কাজের মাধ্যমে দ্রুত শিখন 
২.সমাজকল্যাণ: সামাজিক দায়িত্ববোধ তৈরি 
৩.আত্মনির্ভরতা: শিল্পজাত দ্রব্য বিক্রি করে আয় 
৪.আনন্দদায়ক: একঘেয়েমিহীন শিক্ষা 
৫.শ্রমের মর্যাদা: কায়িক শ্রমের প্রতি সম্মান 
৬.বাস্তবধর্মী: জীবনমুখী শিক্ষা 
৭.বৃত্তিমূলক: ভবিষ্যৎ জীবিকার সুযোগ

বুনিয়াদি শিক্ষার সীমাবদ্ধতা

১. সীমিত কর্মতৎপরতা: একটি মাত্র শিল্পে সীমাবদ্ধ 
২.অনুবন্ধ পদ্ধতির সমস্যা: সব বিষয় একটি শিল্পের সাথে যুক্ত করা কঠিন 
৩.প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব 
৪.মানসিক বিকাশে বাধা: বহুমুখী চাহিদা পূরণে ব্যর্থ 
৫.অবাস্তব আদর্শ: স্বনির্ভরতার ধারণা অবাস্তব
৬.ইংরেজির অনুপস্থিতি: আন্তর্জাতিক ভাষাকে উপেক্ষা 
৭.শহুরে প্রয়োজনে: প্রধানত গ্রাম্য পরিবেশের জন্য



৬. গুণাবলি (Merits) ও দুর্বলতা (Demerits)

Merits:

1. কর্মের মাধ্যমে শিক্ষার অঙ্গীভূত বাস্তবতা।

2. সামাজিক কল্যাণবোধ ও স্বনির্ভরতা।

3. শিক্ষার্থীর চরিত্র, সহনশীলতা, আত্মসংযম ও আত্মত্যাগের বিকাশ।

4. শিক্ষার আনন্দ ও কার্যকরী ফলাফল।


Demerits:

1. একক শিল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধতা → সৃজনশীলতা সীমিত।

2. শিক্ষক-সংকট।

3. শহুরে পরিবেশে প্রয়োগ কঠিন।

4. স্বনির্ভরতার ধারণা কিছু ক্ষেত্রে অবাস্তব।


জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন ভারতের শিক্ষা ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যা:

· ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয় চেতনা জাগরিত করে
· স্বদেশী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করে
· মাতৃভাষায় শিক্ষার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করে
· বৃত্তিমূলক ও জীবনমুখী শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করে
· ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে


উপসংহার: জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন ছিল ভারতীয়দের স্বাধীন চিন্তা, স্বদেশী সংস্কৃতি এবং স্বাবলম্বী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার এক ঐতিহাসিক প্রয়াস যা ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

Comments

Popular posts from this blog

National Education Policy (2020)

Charter Act of 1813 and Its Educational Implication.

National Policy on Education (1968)