Basic Education1937

  বুনিয়াদি শিক্ষা (Basic Education / Nai Talim / Wardha Scheme)

প্রবর্তকঃ মহাত্মা গান্ধি (Mahatma Gandhi) , 1937 খ্রিস্টাব্দ

 ভূমিকা (Introduction) :   ১৯৩৭ সালে স্বায়ত্তশাসন প্রাপ্ত সাতটি প্রদেশে কংগ্রেস সরকার গঠনের পর ভারতের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুনভাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। এই সময়ে দেশের শিক্ষার উদ্দেশ্য ও রূপ নিয়ে ব্যাপক চিন্তাভাবনা চলছিল। ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার অনুকরণে গঠিত শিক্ষাব্যবস্থা ভারতীয় সমাজের প্রয়োজন ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।এই প্রেক্ষাপটে মহাত্মা গান্ধি তাঁর নতুন শিক্ষা পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যা ‘বুনিয়াদি শিক্ষা (Basic Education)’ বা ‘নাই তালিম (Nai Talim)’ নামে পরিচিত। গান্ধিজি প্রথমে তাঁর ভাবনাগুলি প্রকাশ করেন ‘Harijan’ পত্রিকায় (১৯৩৭)। পরবর্তীতে ZakIr Hussain Committee (Wardha Committee) সেই ভাবনাগুলিকে বাস্তব রূপ দেয়।

গান্ধিজির শিক্ষাদর্শের মূল কথা ছিল — “Education for life, through life and throughout life.”

অর্থাৎ জীবনই শিক্ষা, শিক্ষাই জীবন।


গান্ধিজির বুনিয়াদি শিক্ষার দর্শন (Philosophy Behind Basic Education)

গান্ধিজির মতে, শিক্ষা কেবল পুস্তকনির্ভর নয়, বরং এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা শিশুর শরীর, মন ও আত্মার সর্বাঙ্গীন বিকাশ ঘটায়।

তিনি বিশ্বাস করতেন—

শ্রমই শিক্ষা,

জীবনযাপন ও কর্মই শিক্ষার ক্ষেত্র,

শিক্ষা ও অর্থনীতির মধ্যে সংযোগ থাকা উচিত,

শিক্ষা হবে স্বনির্ভর, আত্মনির্ভর ও সামাজিকভাবে উৎপাদনশীল।

এইভাবে শিক্ষা সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির সঙ্গে একত্রে যুক্ত হবে।


অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি (Economic and Social Base)

1. শিক্ষা ও কর্মের ঐক্য:

শিক্ষার্থীদের এমন কাজে যুক্ত করতে হবে যা উৎপাদনমূলক এবং সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয়।

যেমন – সুতা কাটা, চামড়ার কাজ, কৃষি, কাঠের কাজ ইত্যাদি।

2. স্বনির্ভরতা (Self-sufficiency):

শিক্ষার্থীরা তাদের শ্রম দ্বারা নিজেদের শিক্ষার খরচ জোগাবে — এই নীতিকে তিনি বলেছিলেন “Learning by Earning.”

3. সমাজভিত্তিক শিক্ষা:

বিদ্যালয় হবে সমাজের অংশ, এবং সমাজের উন্নয়ন হবে বিদ্যালয়ের কার্যক্রমের অংশ।

4. নৈতিক ও নাগরিক শিক্ষা:

শিক্ষা শুধু বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধও গড়ে তুলবে।



বুনিয়াদি শিক্ষার বৈশিষ্ট্য (Characteristics / Features)

1. ৭ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক শিক্ষা।

2. মাতৃভাষায় শিক্ষা: শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা, ইংরেজি নয়।

3. শিল্পভিত্তিক শিক্ষা (Craft-centred Education): প্রতিটি বিদ্যালয়ে স্থানীয় প্রয়োজন ও পরিবেশ অনুযায়ী একটি প্রধান শিল্প বা হস্তকলা কেন্দ্রীয় ভূমিকা নেবে।

4. শিক্ষার্থীর শ্রম দিয়ে শিক্ষার ব্যয়ভার বহন।

5. অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা (Learning by Doing): শিক্ষার্থীরা বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখবে।

6. বই ও পরীক্ষার প্রতি নির্ভরতা কম।

7. পিতামাতা, প্রাপ্তবয়স্ক ও সমাজের অন্যান্য অংশগ্রহণও অন্তর্ভুক্ত।

8. দৈনন্দিন কাজের ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন (Internal Evaluation)।

9. শিক্ষার চার স্তর: 

A.প্রাক-বুনিয়াদি স্তর (০–৬ বছর)

B.জুনিয়র বেসিক (৭–১০ বছর)

C.সিনিয়র বেসিক (১১–১৪ বছর)

পোস্ট-বেসিক (১৪ বছরের পর)

 কেন একে “বুনিয়াদি” বলা হয়? (Why Called Basic Education)

1. এটি ভারতের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভিত্তিতে গঠিত।

2. ব্যক্তি ও জাতির ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন পূরণই লক্ষ্য।

3. সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে গড়ে উঠেছে।

4. সমাজের প্রতিটি শ্রেণির (ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে) জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।

5. শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা, স্বনির্ভরতা ও সমাজসেবার সঙ্গে যুক্ত।


 পরবর্তী অবস্থা (Subsequent Development)

1. 1944 – সার্জেন্ট রিপোর্ট: সার্জেন্ট রিপোর্ট বুনিয়াদি শিক্ষাকে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

2. 1955 – কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বুনিয়াদি শিক্ষা পর্যালোচনা কমিটি: প্রস্তাব দেয় –

Post Graduate Basic College স্থাপন।

গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা।

শিক্ষার্থীদের দক্ষতা মূল্যায়নের জন্য কমিটি।

সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতা বৃদ্ধি।

3. 1964–66 – কোঠারি কমিশন:

বুনিয়াদি শিক্ষার তিনটি মূল্যবোধ নির্ধারণ করে —

1️⃣ কায়িক শ্রমের মর্যাদা।

2️⃣ সমাজসেবা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ।

3️⃣ ধর্মনিরপেক্ষতা।


কমিশনের সুপারিশে পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়:

সাফাই, কৃষি, শিল্প, সমাজসেবা, প্রার্থনা, নৈতিক শিক্ষা, প্রাপ্তবয়স্ক সাক্ষরতা ইত্যাদি।

মাধ্যমিক স্তরে “Work Experience”

কলেজ স্তরে NSS (National Service Scheme) প্রবর্তন।


 বুনিয়াদি শিক্ষার উপযোগিতা (Utility / Importance)

1. জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক চেতনা গঠন।

2. স্বনির্ভরতা ও আত্মনির্ভর জীবনের শিক্ষা।

3. অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর (Economically Viable): শ্রমভিত্তিক শিক্ষায় উৎপাদন বৃদ্ধি ও ব্যয় হ্রাস ঘটে।

4. সামাজিকভাবে সমতাভিত্তিক: জাত, ধর্ম, লিঙ্গ ও শ্রেণিভেদ দূর করে।

5. মনোবিজ্ঞানসম্মত ও শিশুকেন্দ্রিক।

6. গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে শিক্ষা যুক্ত করে।

7. নৈতিক ও চরিত্রগঠনের শিক্ষা।

8. শিক্ষা ও জীবনের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করে।

9. জাতীয় অর্থনীতির পুনর্গঠনে সহায়ক।


 ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা (Defects and Limitations)

1. প্রয়োগের ব্যর্থতা: শিক্ষক, প্রশাসক ও সমাজের উদাসীনতা পরিকল্পনাকে দুর্বল করে তোলে।

2. শিল্পনির্ভরতার ভুল ধারণা: কেউ কেউ মনে করতেন, বিদ্যালয় ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।

3. লিবারেল শিক্ষার অভাব: শিল্পশিক্ষা থাকলেও সাহিত্য, বিজ্ঞান ও মানবিক মূল্যবোধ অবহেলিত।

4. সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির বিরাগ: মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণি এই শিক্ষাকে নিম্নমানের মনে করত।

5. অর্থের অভাব ও প্রশাসনিক অদক্ষতা।

6. বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অভাব।

7. যথাযথ শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও মানসম্মত পাঠ্যসূচির অভাব।


 সমালোচনা (Criticism)

1. গান্ধিজির শিক্ষাদর্শ তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতায় প্রগতিশীল হলেও, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ছিল না।

2. এটি শিল্পায়নের যুগে দ্রুত উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত ছিল না।

3. বুনিয়াদি শিক্ষা ভারতের শিক্ষা-প্রবাহে স্থায়ী রূপ নিতে পারেনি।

4. অনেক প্রদেশে এটি কেবল পরীক্ষামূলক স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল।

তবুও এর আদর্শবাদী নীতি ভারতের শিক্ষাদর্শে চিরকাল প্রাসঙ্গিক — “শিক্ষা হবে জীবনের সঙ্গে একাত্ম, সমাজের সঙ্গে যুক্ত এবং মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ।”

 মূল্যায়ন (Evaluation)

বুনিয়াদি শিক্ষা ভারতের প্রথম পূর্ণাঙ্গ জাতীয় শিক্ষা দর্শন।এটি পরবর্তী সব শিক্ষানীতি (সার্জেন্ট রিপোর্ট, কোঠারি কমিশন, 1968 NPE, 1986 NPE এবং 2020 NEP)-এর দার্শনিক ভিত্তি স্থাপন করেছে।এর মাধ্যমে “শিক্ষা = জীবন” ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।এটি ভারতের শিক্ষাকে বিদেশি ছাঁচ থেকে মুক্ত করে দেশীয় সংস্কৃতিতে স্থাপন করেছে।

 উপসংহার (Conclusion) বুনিয়াদি শিক্ষা কেবল শিক্ষানীতি নয়, এটি ভারতের সামাজিক পুনর্গঠনের দর্শন।মহাত্মা গান্ধি শিক্ষাকে কেবল মস্তিষ্কের নয়, বরং হৃদয়, হাত ও আত্মার একত্র বিকাশের মাধ্যম হিসেবে দেখেছিলেন।যদিও তা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি, তবু আজও “Nai Talim” ভারতের শিক্ষা-চিন্তায় এক অনন্য আদর্শ হিসেবে স্থায়ী হয়ে আছে।

Comments

Popular posts from this blog

National Education Policy (2020)

Charter Act of 1813 and Its Educational Implication.

National Policy on Education (1968)